২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ডবল ডিজিটে নেয়ার যে স্বপ্ন দেখছে তা বাস্তবায়নের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে যার জোরালো সম্ভাবনা- তারই সমর্থন ও স্বীকৃতি এবার মিলল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ডেভেলপমেন্ট আউটলুক আপডেটে।
একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের ভেতরের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিমাপ হলো জিডিপি, যা কিনা অর্থমূল্যে বা টাকার অঙ্কে প্রকাশিত হয়। এটি অর্থনীতির আকার বা পরিমাণ নির্দেশ করে। আগের বছরের তুলনায় বর্তমান বছরে যে হারে এই পরিমাণ বাড়ে, তাই হলো প্রবৃদ্ধির হার। তবে এই হার কতটা টেকসই তা নির্ভর করে কোন কোন উৎস এ প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে তার ওপর। কারা এ প্রবৃদ্ধির সুফল ভোগ করছে, তার মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধির গুণমান প্রতিফলিত হয়। বর্তমানে জিডিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির ৪২তম দেশ। ক্রমাগত উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে বাংলাদেশ এই এক যুগে বিশ্ব অর্থনীতির সারণিতে ১৬ ধাপ অগ্রসর হবে। ৭৫টি দেশের মধ্যে এটিই হবে সবচেয়ে বেশি অগ্রসর হওয়া।
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রক্ষেপন করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটির ইঙ্গিত হলো এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল দেশ হিসেবে বজায় থাকবে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি চীন, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত ও পাকিস্তান সহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ ছাড়িয়ে যাবে, অর্থাৎ ৮ শতাংশে থাকবে বলেও অভিমত প্রকাশ করা হয় এতে।
এডিবির আউটলুক অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে বাংলাদেশে হবে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হবে ভারতে, সাত দশমিক দুই শতাংশ। এ ছাড়া এশিয়ায় গড়ে সাড়ে পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। এডিবির আউটলুক অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ছাড়া মাত্র দুটি দেশ ৭ বা এর বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। এর মধ্যে ভারত ৭ দশমিক ২ এবং তাজিকিস্তান ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। এ ছাড়া ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে মোট ১০টি দেশ। দেশগুলো হলো চীন, মঙ্গোলিয়া, উজবেকিস্তান, ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ, কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার ও ফিলিপাইন।
বাংলাদেশ এখন এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারে গত দুই যুগে সিঙ্গাপুর ও হংকংকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ এই অবস্থানে উঠল। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সমতা (পিপিপি) বিবেচনা করে প্রতিটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কত হয়েছে, সেই হিসাব করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। আর এভাবে দেশগুলোর অর্থনীতির আকার নির্ধারণ করা হয়। সেই হিসাবে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে মোট ৭০ হাজার ৪১৬ কোটি ডলারের সমপরিমাণ পণ্য উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টি হয়েছে।
এডিবির ‘কি ইনডিকেটরস ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের এই চিত্র উঠে এসেছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতা (পিপিপি) অনুসারে হিসাব করলে বিভিন্ন দেশের আর্থিক সক্ষমতার তুলনামূলক প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়। এডিবির প্রতিবেদনে পিপিপি অনুযায়ী এশিয়ায় সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ চীন। দেশটির মোট জিডিপির আকার ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ১৭৩ কোটি ডলার। দ্বিতীয় স্থানে আছে ভারত, যেখানে জিডিপির আকার ১০ লাখ ৪৭ হাজার ৪৩৩ কোটি ডলার। এডিবির ওই প্রতিবেদনে এশিয়ার ৪৯টি দেশের মধ্যে কার কত জিডিপির আকার, তা দেখানো হয়েছে।
এবার দেখা যাক, গত দেড় যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রাটি কেমন ছিল। এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০০ সালে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল সিঙ্গাপুর। ওই বছর বাংলাদেশে মাত্র ১৫ হাজার ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন সিঙ্গাপুরে সৃষ্টি হয়েছিল ১৬ হাজার ৭১৮ কোটি ডলারের পণ্য উৎপাদন ও সেবা। এরপর বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। পরের ১০ বছরেই সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। ২০১০ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়ায় ৩৬ হাজার ৪০৫ কোটি ডলার। ওই বছরই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে সিঙ্গাপুর। তখন সিঙ্গাপুরে পণ্য উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬ হাজার ৩৩২ কোটি ডলার। এরপর বাংলাদেশের শুধু এগিয়ে যাওয়ার গল্প। ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশ বেশি।
একইভাবে হংকংকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। এই দেশটিও ২০০০ সালে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল। কিন্তু ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো হংকংকে পেছনে ফেলে দেয় বাংলাদেশ। গত বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বেড়ে হংকংয়ের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি হয়েছে। তবে উন্নয়নের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ওই দুটি দেশের চেয়ে অনেক পেছনে।
৪৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। চীন ১ নম্বরে। পিপিপি অনুসারে জিডিপির আকার ৭০,৪১৬ কোটি ডলার সিঙ্গাপুর, হংকং ও নিউজিল্যান্ডের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৫টি দেশের মোট জিডিপি বাংলাদেশের ১০ শতাংশের কম।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ বলেন, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে তুলনামূলক দুর্বল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। আগের চেয়ে বাড়তে পারে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। এ ছাড়া সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতির ফলে অর্থনীতিতে উদ্দীপনা অব্যাহত থাকবে।
এডিবির মতে, এ উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে রমরমা রপ্তানি, মানুষের ভোগের জন্য ব্যয় বাড়ানো, উচ্চ রেমিট্যান্স, সমন্বিত মুদ্রানীতি, বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে চলমান সংস্কার ও অবকাঠামোতে সরকারি বিনিয়োগ।
শিল্প ও কৃষি খাতে টেকসই শক্তিশালী বিকাশ ২০২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধিতে মূল চালিকাশক্তি হবে বলে আশা করা হচ্ছে, জানায় এডিবি। ব্যাংকটির এ দেশীয় পরিচালক মনমোহন প্রকাশ বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো পর্যায়ে রয়েছে এবং তার বিকাশ অব্যাহত থাকতে পারে। ২০২০ অর্থবছরে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে, এডিবির আউটলুক ইঙ্গিত করছে যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে বজায় থাকতে পারে বাংলাদেশ।’
বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে দুর্বলতা থাকার পরও বাংলাদেশের জন্য অনুকূল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা প্রত্যাশা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। রাজধানীতে নিজ কার্যালয়ে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক ২০১৯ আপডেট প্রকাশকালে মনমোহন বলেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আরও শক্তিশালী হতে পারে।
এ অগ্রগতি মাঝারি ও দীর্ঘ মেয়াদে ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশকে কতগুলো চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে বলে মত দেন এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এর কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ । তিনি বলেন, বাংলাদেশের দরকার শিল্প খাতে প্রসারিত ভিত্তি, রপ্তানিতে বৈচিত্র্য, শহর ও গ্রামে পক্ষপাতশূন্য উন্নয়ন এবং শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থা।
বেসরকারি খাতকে প্রাণবন্ত করার জন্য ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে কর্তৃপক্ষকে সংস্কার কাজে গতি আনতে হবে বলে মন্তব্য করেন মনমোহন। মূসক আইনের বাস্তবায়নকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, বেসরকারি খাতের উঠতি চাহিদা পূরণে বাংলাদেশের মানব সম্পদের আরও উন্নয়ন করতে হবে।
মনমোহন প্রকাশ আরও বলেন, ‘এডিবি মনে করছে শিল্প খাতের উন্নয়নের ফলে এ প্রবৃদ্ধি হবে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস সেক্টরে পণ্য রপ্তানিতে প্রায় ১০ শতাংশের উপরে জিডিপি অর্জন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশের অবকাঠামোখাতে ব্যাপক উন্নয়নের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশে এখন ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। তবে এটা ধরে রাখা হলো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’
দেশের জিডিপি ডবল ডিজিটে উন্নীত করার জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেশের জিডিপির হার ৭-৮ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশে নিয়ে যেতে বেসরকারীভাবে বিনিয়োগের হার আরও বৃদ্ধি করতে হবে। প্রবৃদ্ধি ১০-এ উন্নীত করতে হলে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ড অত্যাবশ্যক। অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের বদলে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা হলে যে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হবে- সেকথা বলাই বাহুল্য। সেজন্য চলমান প্রতিটি অর্থনৈতিক প্রকল্পেরই মূল্যায়ন ও মনিটরিং প্রয়োজন নিয়মিতভাবে। প্রবৃদ্ধি বাড়ানো নিশ্চিত করতে একই সঙ্গে বেসরকারী বিনিয়োগ খাতকেও গতিশীল করতে হবে।
লেখকঃ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১