বাণিজ্যিক ব্যাংকের নামের শেষে ‘পিএলসি’, সুবিধা-অসুবিধা

এম এ মাসুম || ২০২৩-০৮-০৯ ২৩:১৯:৩৩

image

বিশ্বের অনেক দেশের ব্যাংকের নামের শেষে সংশ্লিষ্ট দেশের নিজস্ব ভাষায় অথবা ইংরেজিতে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানী লেখা হয়। যেমন জার্মানীর ব্যাংক এর নামের শেষে জিএমবিএইচ (GmbH) লেখা হয় যার জার্মানী ভাষায় অর্থ হচ্ছে“Gesellschaft mit beschränkter Haftung,” বা ইংরেজীতে “Company with Limited Liability.” সিঙ্গাপুর এর ব্যাংকগুলোর নামের শেষে  LLC অর্থাৎ 'Limited Liability Company' বা 'Company with Limited Liability'.উল্লেখ করা হয়। মালয়েশিয়ান ব্যাংকগুলোর নামের শেষে Berhad (BHD) যার অর্থ private limited company উল্লেখ করা হয়।  তেমনি সুইজারল্যন্ডের ব্যাংকের নামের শেষে  AG' বা 'stock corporation' or 'shares corporation' বা Private Limited Company উল্লেখ থাকে।

মূলতঃ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীকে সংক্ষেপে পিএলসি এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানীকে এলটিডি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। এই দুই ধরণের প্রতিষ্ঠানের মৌলিক পার্থক্য হলো প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানীর শেয়ার সহজে হস্তান্তরযোগ্য নয়, ব্যক্তিগতভাবে তা ক্রয় বিক্রয় হতে পারে সাধারণ মানুষ এর শেয়ার ধারণ করতে পারেনা। অন্যদিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীর শেয়ার সহজে ক্রয় বিক্রয় করা যায় এবং সাধারণ মানুষ এর শেয়ার ক্রয় বিক্রয় করতে পারে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক তাদের নামের শেষে লিমিটেড শব্দটি ব্যবহার করে। লিমিটেডকে অনেক সময় এলটিডি দিয়ে প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ এটি প্রাইভেট কোম্পানী। বিশেষজ্ঞগণ তাই মনে করেন আমাদের দেশের ব্যাংকের নামের সাথে লিমিটেড শব্দ ব্যবহার বহুল প্রচলিত একটি ভুল।

এতদিন বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে নামের শেষে শুধু ‘লি (লিমিটেড)’ থাকলেও এখন তা প্রতিস্থাপিত হবে ‘পিএলসি (পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি)’ দিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ কর্তৃক ইস্যুকৃত বিআরপিডি সার্কুলার নং-০৪ তারিখ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এর নির্দেশনা অনুযায়ী ‘পাবলিক সীমিতদায় কোম্পানি’ শনাক্ত করার লক্ষ্যে ব্যাংক কোম্পানিগুলোর নামের শেষে পিএলসি (পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি) যোগ করতে হবে।

নিয়ম অনুযায়ী নামের শেষে ‘পিএলস’ যুক্ত করতে ব্যাংকের পর্ষদ (এজিএম) এর অনুমোদন নিতে হবে। পর্ষদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে তা যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) এর কাছে জানাতে হবে। তারপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নাম ও সংঘস্মারকে আনা পরিবর্তন লিখিতভাবে জানাতে হবে গেজেট আকারে প্রকাশ করতে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যাংক-কোম্পানির নাম ও সংঘস্মারক (Memorandum of Association) পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে।  তবে নামের শেষে পিএলসি যোগ করতে ব্যাংক কোম্পানিগুলোকে আলাদা করে কোনো আবেদন করতে হবে না।

নামের শেষে ‘পাবলিক সীমিতদায় কোম্পানি’ বা পিএলসি শব্দটি যোগ করতে প্রয়োজনীয় আইনি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে ব্যাংক কোম্পানিগুলোকে অনুমতিও দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে ব্যাংকের ওই পরিপত্রে। ব্যাংক পরিবর্তনের বিষয়টি ব্যাংকের বিশেষ সাধারণ সভায় (এজিএম) এ অনুমোদন নিতে হবে।  তাছাড়া, নাম পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকে জানাতে হবে এবং পরিবর্তিত নামের গেজেট প্রকাশের জন্য ব্যাংক কোম্পানিগুলোকে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগে আবেদন দাখিল করতে হবে।

পরিপত্রে বলা হয়, কোম্পানি (দ্বিতীয় সংশোধন) আইন, ২০২০ এর মাধ্যমে কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ (১৯৯৪ সালের ১৮ নং আইন)-এ ‘সীমিতদায় কোম্পানি সনাক্তকরণ (Indication of Limited Company)’ সংক্রান্ত ১১ক ধারা নতুন করে সন্নিবেশন করা হয়েছে। সন্নিবেশিত ধারার (ক) উপ-ধারাতে ‘সীমিতদায় পাবলিক কোম্পানির ক্ষেত্রে উহার নামের শেষে ‘পাবলিক সীমিতদায় কোম্পানি’ বা “PLC.” শব্দসমূহ লিখিতে হইবে’ মর্মে বিধান রাখা হয়। উক্ত বিধান পরিপালনার্থে, ব্যাংক-কোম্পানীসমূহের নামের শেষে “পাবলিক সীমিতদায় কোম্পানি” বা “PLC.” অন্তর্ভুক্ত করতে হলে ব্যাংক-কোম্পানির নাম ও সংঘস্মারক পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ১১৬ ও ১১৭ ধারা অনুযায়ী ব্যাংক-কোম্পানি সমূহের যথাক্রমে নাম ও সংঘস্মারক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে।

ব্যাংক-কোম্পানীসমূহের নামের শেষে ‘পাবলিক সীমিতদায় কোম্পানি’ বা “PLC,” অন্তর্ভুক্ত করার আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের ক্ষেত্রে ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর যথাক্রমে ১১৬ ও ১১৭ ধারার আওতায় ব্যাংক-কোম্পানিসমূহ কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবরে পৃথকভাবে আবেদন দাখিলের প্রয়োজন হবে না। তবে নাম পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদন করার পর বিষয়টি অবগতিসহ পরিবর্তিত নামের গেজেট প্রকাশের জন্য ব্যাংক-কোম্পানি সমূহকে এ বিভাগে আবেদন দাখিল করতে হবে।

মোট কথা, যেসব সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংক স্টক একচেঞ্জের মাধ্যমে শেয়ার ইস্যু করেছে সেসব ব্যাংকের নামের শেষেই পিএলসি যোগ করতে হবে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৪টি ব্যাংকের ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকেও জানাতে হবে পরিবর্তনের বিষয়টি। আর বিনিয়োগকারীদের জন্য মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) প্রকাশ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে।

বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। এরমধ্যে কয়েকটি বিদেশি ও সর্বশেষ অনুমোদন পাওয়া কয়েকটি ব্যাংকের নামের শেষে পিএলসি শব্দ রয়েছে।  বাস্তবতা হচ্ছে ব্যাংকের নামের শেষে পিএলসি যুক্ত করার ফলে নতুন ভাবে একটি ব্যাংকের সুমান বৃদ্ধি বা হ্রাস, উন্নত বা অনুন্নত প্রকাশ পায়না বা গ্রাহকদের আস্থা হ্রাস বা বৃদ্ধি কোন কিছুর উপর প্রভাব বিস্তার করেনা। সম্প্রতি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সরকার ও বেসরকারী ব্যাংকের নামের শেষে পিএলসি যুক্ত করা হয়েছে যা শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ পরিপালনের জন্য।  আশা করি ব্যাংকার ও গ্রাহকদের মধ্যে বিষয়টি পরিস্কার হয়েছে।

লেখক: এম এ মাসুম, ব্যাংকার এবং “বৈদেশিক বিনিময় বাণিজ্য ও অর্থায়ন” গ্রন্থের লেখক

 ইমেইল: ma_masum@yahoo.com

অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com

ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১