কিংবদন্তী ব্যাংকার লুৎফর রহমান সরকারের ৮৯তম জন্ম দিনে

মোহাম্মদ আবদুল মান্নান || ২০২২-০২-০৪ ০৭:৪০:৫৭

image

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এবং ব্যাংকিংকে আধুনিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে  লুৎফর রহমান সরকার (১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪- ২৪ জুন ২০১৩) অগ্রগণ্য।

‘বিকল্প’খ্যাত কিংবদন্তি ব্যাংকার, আত্মকর্মসংস্থান ধারণার অন্যতম পথিকৃৎ, গণমুখী ব্যাংক ব্যবস্থার পথ প্রদর্শকরূপে লুৎফর রহমান সরকার দেশের ব্যাংকিং জগতের প্রবাদ পুরুষ। ১ ফেবরুয়ারি তার ৮৯তম জন্ম দিন।

১৯৩৪ সালে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের ফুলকোট গ্রামে তা জন্ম। বাবা মরহুম দেরাছ উল্লা সরকার, মা মরহুমা আসাতুন নেছা খাতুন, চাচা মরহুম ডাঃ আফাজ উল্লাহ সরকার আর চাচী ছিলেন সাড়া জাগানো দস্যু বনহুর সিরিজের লেখিকা বেগম রোমেনা আফাজ।

১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পাস করে রেডিও পাকিস্তানের করাচী অফিসে মনিটরিং বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়ে লুৎফর রহমান সরকার কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৫৭ সালে হাবিব ব্যাংকে যোগ দেন এবং ১৯৬১ সালে বগুড়া শাখার ব্যবস্থাপক হন।

১৯৬৫ সালে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক অফ পাকিস্তানের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৭২ সালে রূপালী ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক বা ডিজিএম হন। ১৯৭৬ সালে মহাব্যবস্থাপক হয়ে অগ্রণী ব্যাংকে বদলী হন। তখন থেকেই তিনি ব্যক্তিত্ব, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী উদ্যোগের কারণে ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে একজন ব্যতিক্রমধর্মী সৃজনশীল উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাংকার হিসাবে পরিচিত হতে থাকেন।

রুটিন কাজের ব্যবস্থাপক না হয়ে রুটিনের বাইরে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেন তিনি। সক্রিয় চেতনার মানুষ হিসেবে ব্যাংকিং-এর পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যে অনুরাগ, লেখালেখি ও লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি আগ্রহ তাকে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও জনপ্রিয় করে। সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে তখন থেকেই তার কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়। পরে তাকে জানার সুযোগ ঘটে আরো বহু মাত্রায়।

লুতফর রহমান সরকার অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে ১৯৮৩ সালে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন। তিনি তখন ‘আয় থেকে দায় শোধ’ ভিত্তিতে ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প’ (বিকল্প) চালু করেন। শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া দেশের স্কুল পাশ যুবকরা চেয়ার-টেবিলে বসে কেরানীগিরি করা ছাড়া অন্য কাজ করতে এক সময় মোটেই রাজি ছিল না। ক্ষেতে-খামারে যাবে না। কারখানার কাজ শিখবে না। এমন  অবস্থায় আশির দশকের শুরুতেও লেখাপড়া জানা লোকেরা কায়িক পরিশ্রমের কাজে লজ্জাবোধ করতো।

সে অবস্থায় লুৎফর রহমান সরকার বেকার যুবকদের বিকল্প কর্মক্ষেত্রের সন্ধান দেন। তাদের জন্য কাজের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেন। তার এই উদ্যোগ যুবকদের জীবনদৃষ্টি পাল্টাতে সাহায্য করে। বেকারত্ব দূর করা ও শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি উদ্যোগ ও মেধাকে ব্যবসা-বানিজ্যে আকৃষ্ট করার উদ্যোগ নেন। শিক্ষিতদেরকে শ্রমঘনিষ্ট  মিনিবাস, ট্যাক্সি, ক্লিনিক, টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, ফার্মাসিউটিক্যালস, ইন্জিনিয়ারিং, প্রিন্টিং, ফটোস্ট্যাট এবং শিল্প, কৃষি, ও অন্যান্য ব্যবসায় টানতে শিক্ষা সার্টিফিকেট জমা রেখে অন্য জামানতহীন বিনিয়োগ চালু করেন।

তার সাড়া জাগানো ভিন্নমাত্রার ব্যাংকিং নিয়ে তখন তুমুল আলোচনা শুরু হয়। আর প্রকল্পের নীতি ও পদ্ধতি বাস্তবায়নে তখন তিনি সামরিক সরকারের কর্তাব্যক্তিদের অসঙ্গত নির্দেশনা ও সংকীর্ণ দলীয় বিরূপতার মুখে পড়েন। সরকারী ব্যাংকে বসে তার এই বশ না মানার স্পর্ধা তার ভোগান্তির কারণ হয়। প্রচন্ড ন্যায়বোধ নিয়ে তিনি তবু অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার না করে তিন সহকর্মীসহ গ্রেফতার হন। সামরিক আদালতের বিচারে দুই বছরের কারাদন্ড পান। (তাদের একজন ছিলেন সোনালী ব্যাংকের তখনকার জেনারেল ম্যানেজার এ, কিউ সিদ্দিকী পরে তিনি ব্যাংকটির এমডি হন। বাকি দু’জনের একজন ছিলেন ডিজিএম আব্দুল কাইয়ুম ও অন্যজন এজিএম মোহাম্মদ রফিকুল্লাহ।) কারাবাস সয়ে পর্বতের মতো মাথা সোজা রাখেন। তাদের মুক্তির জন্য রাজপথের আন্দোলন ব্যাকারে জীবনে নতুন নযীর তৈরি করে।

প্রথাগতভাবে একজন ব্যাংকার খুব কমই নিয়ম বদলাতে পারেন। ভেতর থেকে আছে ‘অন্তরের অবরোধ’। সেই সরিষার ভূত ছাড়াও আছে কায়েমি স্বার্থের দ্বন্দ্ব। এই বেড়া ভেঙে কতটা করা সম্ভব সেই সীমানা তিনি বুঝতেন না এমন নয়। তার পরও তিনি পথ কিছুটা তৈরি করে গেছেন। এখন শিক্ষিত ছেলেরা শুধু অফিসে চাকরি খোঁজে না। এর বাইরে মেকানিক্যাল-টেকনিক্যাল-ভোকেশনাল বহু কাজ তারা নিজেরাই তৈরি করে। এই পরিবর্তনের পেছনে একজন লুৎফর রহমান সরকারের ভূমিকাকে আমাদের সমাজে ছোট করার জো নেই। 

লুৎফর রহমান সরকারকে নিয়ে এক সময় ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে নানা গল্প-কেচ্ছা চালু হয়। একজন দীর্ঘদেহী মানানসই চেহারার সুদর্শন মানুষ। বীরপূজারি বাঙালি এমন চেহারার প্রতি দুর্বল। তারা প্রচার করে: তিনি হাঁটতে হাঁটতে বিনিয়োগ দেন। পথে পথে ব্যাংকের টাকা বিলান। আরো কত কি! সোনালী ব্যাংকের কোন শাখা পরিদর্শনে গিয়ে তিনি হয়তো দেখেন ঘরের বাইরে পিড়ায় কিছু জেলে বসে ঝিমুচ্ছে। তিনি জানতে চান, তাদের জাল আছে কী-না। পুঁজি আছে কী-না। তারপর বলেন: ‘ওদের বিনিয়োগ দাও। আমি স্বাক্ষর করে দিচ্ছি!’ তিনি কখনো নদী পারাপারের ফেরীতে চরনদার কাউকে উদ্যোগী মনে করে তার জন্য বিনিয়োগের ব্যবস্থা করেন! --এসব গল্পে সত্য-মিথ্যা যা-ই থাক, লুৎফর রহমান সরকার বাস্তবে এমন মানুষ ছিলেন, তা আমি কিছুদিন তার সাথে কাজ করার সময় কাছে থেকে বুঝেছি।

তার কথা সবাই সহজে বোঝার বা মানার কথা নয়। তাই তিনি গঞ্জনা সয়েছেন। তবে দমেননি। তার মনের ভেতর তিনি কিছু যুক্তি লালন করতেন: ‘কোটিপতিরা অনেকে কোটিকোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেয় না। গরীব মানুষ হাজার টাকা বিনিয়োগ নিয়ে নিজের মাথা সোজা করতে চায়। কৃতজ্ঞ হয়ে টাকা ফেরত দেয়। ফেরত না দিতে পারলেও তা তো মাত্র হাজার টাকার মামলা। এতে অর্থনীতি রসাতলে যাবে না। একটা পরিবার কিছুটা সোজা হবে।’

এমন আবেগের কথা ব্যাংকের কেতাবে লেখা নাই। তবু তিনি নিজের মাঝে সে ফিকির ও জিকির মজবুতভাবে লালন করতেন। বলতেন: ‘কোটিপতি বিনিয়োগ ফেরত না দিলে এক পরিবারের কাছে কোটি কোটি টাকা আটকা পড়ে। অথচ তা দিয়ে শত শত উদ্যোক্তা তৈরি করে বহু পরিবারের উপকার সম্ভব।‘ এমন সহজ করে তিনি জটিল ব্যাংকিং অংক মিলাতে চাইতেন। তার সরলতায় প্রথাসিদ্ধ জাঁদরেল ব্যাংকারের ভড়ং ছিল না। কাছে থেকে তার কথা শুনে আর তার কাজকাম দেখে আমার কখনো মনে হয়েছে, কলিজাটা তার দেহের মাপের চাইতেও বড়।

তিনি পরিবর্তনের বড় স্বপ্ন দেখতেন। আর পরিবর্তন নিশ্চিত করতে দিন-রাত অবিশ্রাম লেগে থাকতেন। এ দিক থেকে তিনি যেমনি প্রচন্ড সাহসি তেমনি পরম ধৈর্যশীল ছিলেন। দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং পাটাতন তার ‘বৈপ্লবিক’ চিন্তা বাস্তবায়নের উপযোগী ছিল না। অচলায়তন ভাঙার উপায় তার জানা ছিল না। তিনি দীর্ঘদিন প্রচলিত ব্যাংকিং কাঠামোর মধ্যে থেকে ব্যাংকে জমা হওয়া জনগণের সম্পদ গরীব ও নিঃস্ব মানুষের মাঝে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে দেয়ালে মাথা ঠুকেছেন।

ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং নিয়ে আশির দশকের শুরুতে তার সাথে কথা বলেন ইসলামী ব্যাংকের প্রথম চেয়ারম্যান আবদর রাজ্জাক লশকর ও সোনালী ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির এম আযীযুল হক। তারা তখন তাকে প্রধান নির্বাহী হিসাবে পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লুতফর রহমান সরকার তখন ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং সম্পর্কে কোন আগ্রহ দেখাননি। শুধু বলেছেন: ‘আপনারা কী বলেন আমি বুঝি না।’

১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক চালু হয়। লুতফর রহমান তখন হন সোনালী ব্যাংকের এমডি। এর পর সময় গড়ায়। তিনি জেলে যান। বের হন।  তার সাথে আবার যোগাযোগ করা হয়। এক পর্যায়ে ইসলামী ব্যাংকের ক’জন উদ্যোক্তার সাথে তার মতবিনিময় হয়। এরপর তিনি নিজস্ব অধ্যয়ন ও অনুধ্যানের মাধ্যমে উপলব্ধি করেন: ইসলামী ব্যাংকিং একটি পদ্ধতিমাত্র নয়। এর বিশেষ স্বতন্ত্র রূপ আর পৃথক রূপকল্প ও কর্মকৌশল আছে। সে রূপকল্প বাস্তবায়নের কর্মধারাটিও নিজস্ব ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্টমন্ডিত। ব্যক্তি-লোভকে দমন করে সার্বজনীন কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে ইসলামী অর্থনীতি সমাজে বন্টনমূলক সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলে।’ এ বিষয় নিয়ে তার বন্ধু ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আজীজুর রহমানও তাকে ইতিবাচক কথা বলেন। শেষে তিনি ১৯৮৮ সালের ১৫ আগস্ট ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন।

তিনি তখন সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের মতো বিরাট নেটওয়ার্কওয়ালা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর আসন থেকে এসে মাত্র সতেরো শাখাবিশিষ্ট ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্ব নেন। তবুও তিনি এখানে পূর্ণ তৃপ্তির মাঝে প্রবেশ করেন। তিনি সারাজীবন মানব কল্যাণের যে আদর্শ লালন করেছেন ইসলামী ব্যাংকিং-এর মাকাসিদ বা লক্ষ তার সেই কল্যানচিন্তার সাথে পুরা মিলে যায়। জীবন মিশন বাস্তবায়নের জন্য তিনি অবিলম্বে ইসলামী ব্যাংকের নীতি, আদর্শ, লক্ষ্য ও কর্ম পরিকল্পনার মাঝে একাত্ম হয়ে ছয় বছরের মধ্যে ইসলামী ব্যাংককে একটি সার্বজনীন, প্রগতিশীল, কল্যাণধর্মী ব্রান্ডিং উপহার দিতে সক্ষম হন। ইসলামী ব্যাংকের জনশক্তির মধ্যে গতি, চাঞ্চল্য ও সামর্থের বিকাশ ঘটাতে এবং ব্যাংকের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের মান বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। কর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গি আরো প্রসারিত করতে এবং তাদের মাঝে ইসলামী ব্যাংকার হিসাবে গৌরববোধ ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিতে তিনি ভূমিকা পালন করেন। উদ্যোগ নেন।

লুৎফর রহমান সরকার বিশ্বাস করতেন, শরী‘আহ অনুগামী একজন মানুষ হবেন দরদি মানুষ। দরদী মানুষদের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে দরদী সমাজ। সেই দরদী সমাজের লক্ষ্য হবে সার্বজনীন কল্যাণ প্রতিষ্ঠা। শরী‘আহ ও কল্যাণ--এই দুইটি বিষয়ের অভিন্নতা স্পষ্ট করতে তিনি ইসলামী ব্যাংকের ‘ইসলামী শরী‘আহ মোতাবেক পরিচালিত’-- বিশেষণমূলক শ্লোগানের সাথে নতুন শব্দগুচ্ছ যুক্ত করেন: ‘কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার প্রবর্তক’। অর্থাত শরী‘য়াহভিত্তিক ব্যাংক চালুর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং-এ কল্যাণধারা চালু করেছে। তার দেয়া এই শব্দ-বন্ধের মধ্যে ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে তার প্রত্যয় ও প্রতীতীও স্পষ্ট। তিনি ইসলামী ব্যাংকের জন্য ছোট পুঁজির ব্যবসার দুয়ার প্রশস্ত করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পথের মানুষ, স্বল্প আয় ও সীমিত আয়ের মানুষ, সদ্য পাশ করা তরুণদের জন্য প্রকল্প চালু করেন। পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প প্রবর্তনে তিনি ভূমিকা পালন করেন। তার দেয়া ‘আয় থেকে দায় শোধ’ শ্লোগান নিয়ে চালু হয় মিশুক প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং সেবায় বড় পরিবর্তনের ধারা তৈরি করে ।

১৯৯৪ সালের ৩০ এপ্রিল ছিল ইসলামী ব্যাংকে লুৎফর রহমান সরকারের শেষ কর্মদিবস। এই দিনটিতেও তিনি তাঁর চেম্বারে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেন। তার সবশেষ কাজ ছিল ইসলামী ব্যাংকের পরবর্তী সাত বছরের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন। যে প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ‘আজ’ বিদায় নিচ্ছেন, সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেন বিদায়ী প্রতিষ্ঠানের পরবর্তি সাত বছরের প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় কলমের শেষ আঁচড় বসাতে। একজন কল্যাণব্রতী স্বপ্নচারী ভিশনারি মানুষের অভিনিবেশ ও অনুধ্যানের এই বৈশিষ্ট, এই আবেগের তাৎপর্য কোন গতানুগতিক চাকরিজীবীর পক্ষে  বোঝা কীভাবে সম্ভব!

ইসলামী ব্যাংক থেকে অবসর নিয়ে তিনি প্রাইম ব্যাংকের প্রতিষ্ঠায় অংশ নেন এবং বযাংকটির প্রথম ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিসাবে তার হাতে এই ব্যাংকে ইসলামী ব্যাংকিং শাখা চালু হয়। ইসলামী ব্যাংক থেকে অবসর নেয়ার পরও তিনি ইসলামী ব্যাংকিং-এর কল্যাণ আদর্শ নানা কর্মক্ষেত্রে বিস্তৃত করেন। প্রাইম ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালকরূপে তিনি সে ব্যাংকে ইসলামী ব্যাংকিং শাখা খুলে প্রচলিত ধারার ব্যাংকে পর্যায়ক্রমিক ইসলামীকরণের নবধারার সূচনা করেন।

বাণিজ্যিক ব্যাংকার থেকে লুতফর রহমান সরকার ১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হন। ১৯৯৮ সালের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের  ব্যাংকিং খাতের প্রধান নীতি-নির্ধারকরূপে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিভিন্ন আলোচনা ও পর্যবেক্ষণে ইসলামী ব্যাংকের স্বাতন্ত্রমন্ডিত কল্যাণমুখী কর্মধারা, ইসলামী ব্যাংকের জনশক্তির সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার প্রশংসা করেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, সমাজে ও সংগঠনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে উন্নত আদর্শের সাথে সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ মানুষ চাই। তেমন মানুষের সমাবেশ ঘটেছে বলেই ইসলামী ব্যাংক  অল্প সময়ে অনেক ভালো কাজ করতে পেরেছে। ইসলামী ব্যাংককে আজীবন তিনি একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে জাতীয় উন্নয়ন ও জন কল্যাণের মডেল হিসাবে হাজির করেছেন। দেশের সকল ইসলামী ব্যাংকের শরী‘আহ কাউন্সিলগুলির সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রিয় শরী‘আহ বোর্ড কায়েমেও তার নির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ষষ্ঠ গভর্ণর হিসাবে অবসর নিয়ে তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। তিনি সেখানে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে দীর্ঘদিন খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সাহিত্য চর্চায় তার আগ্রহ ছিল। তিনি বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার কয়েকটি রম্য ও ছড়ার বই রয়েছে।

এই সদা কর্মিষ্ঠ মানুষটি জীবনের শেষ দিনগুলি শারীরিক অক্ষমতার মাঝে বাস করেন। তখনো তিনি নিয়মিত ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতিটি পরিবর্তন সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন। আরো যেসব গণমুখী ও কল্যাণধর্মী পরিবর্তন ব্যাংকিং খাতে আনা প্রয়োজন সে সম্পর্কেও তিনি তাঁর আকাংক্ষা ও প্রত্যাশা প্রকাশ করতেন।

কয়েক বছর বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে তিনি ৮০ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ২৪ জুন সোমবার সকালে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ইনতেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বাংলাদেশ ব্যাংক চত্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ ও ধানমন্ডি ঈদগাহ মাঠে তিনটি জানাজার পর মরহুমের লাশ বগুড়ায় আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে জানাজা শেষে শহরের ঠনঠনিয়ায় দক্ষিণ বগুড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, অর্থমন্ত্রী, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শোক প্রকাশ করেন। তার ইন্তেকালে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ ইন্টটিউট অফ ব্যাংক ম্যা্নেজমেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমী ও আসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স বাংলাদেশ যৌথভাবে স্মরনসভা ও স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে মরহুমের প্রতি সম্মান জানায়। তার নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েটিং লাউঞ্জের নামকরণ করা হয়।

দেশের ব্যাংকিং খাত যত মানবিক হবে, দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় যা কিছু কল্যাণকর ঘটবে তার মাঝে আমরা লুৎফর রহমান সরকারকে খুঁজে পাব।

আমাদের গ্রুপে যোগদান করতে নীচে ক্লিক করুনঃ

                         

(২০১৩ সালের অক্টোবর সংখ্যা ‘ইসলামী ব্যাক পরিক্রমা’ এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ ইন্টটিউট অফ ব্যাংক ম্যা্নেজমেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমী ও আসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স বাংলাদেশ আয়োজিত যৌথ স্মরনসভা উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থে ছাপা হওয়া আমার নিবন্ধের পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত রূপ)

মোহাম্মদ আবদুল মান্নান

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক-ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড

(লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com

ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১