পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ কমিয়ে আনছেন বিদেশীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিদেশীদের প্রকৃত (নেট) বিনিয়োগ ছিল তিন কোটি ২০ লাখ ডলার, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে গেছে। এতে তহবিল সঙ্কটের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে জানিয়েছেন, বিদেশীরা বিভিন্ন সময় দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করে অর্থের জোগান দেন। এতে প্রতি বছর তারা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মুনাফা নেন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। দেশের যেসব অর্থনৈতিক সূচক রয়েছে তা থেকে সহজেই বোঝা যাবে কোম্পানিগুলোর সামগ্রিক অবস্থা। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে না। এর অর্থ হলো দেশে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। অপর দিকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে। এর অর্থ হলো বিদ্যমান উৎপাাদনক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমে যাবে। আর মুনাফা কমে গেলে বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশও কম পাবেন। এ কারণেই হয়তো বিদেশীরা তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। এতে বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাবে। তবে এতে বড় ধরনের কোনো সঙ্কট হবে না। কারণ, পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট আমাদের দেশে বরাবরই কম ছিল।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল কাশেম খান এ বিষয়ে জানিয়েছেন, পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট গত বছরের জুনের পর থেকেই কমতে ছিল। ওই সময়ে পুঁজিবাজারের সূচকও কমে যায়। তখন থেকে আর স্বাভাবিক অবস্থায় আসেনি। এর পর মার্চ থেকে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় আমাদের পুঁজিবাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব আরো বেশি হারে পড়ে। এমনি একটি অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আর ভরসা রাখতে পারেন না। যেহেতু তাদের বিনিয়োগ ধরে রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই তাই তারা তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। তিনি আশা করেন, আগামী মার্চ-এপ্রিলের পর বিদেশীরা তাদের বিনিয়োগ আবারো বাড়াবেন। তবে সবকিছু নির্ভর করছে করোনাভাইরাসের টিকা আসা ও তার কার্যকারিতার ওপর। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের অভ্যন্তরের কোম্পানিগুলোর অবস্থা খারাপ অবস্থানে চলে গেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে না পারলে আর সেই ক্ষেত্রে সরবরাহ বাড়িয়েও তেমন কোনো লাভ হবে না। যেমনটি বর্তমানে ব্যাংকে চলছে। ব্যাংক থেকে এখন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ নিতে চাচ্ছেন না। কারণ, তাকে তো ঋণ নিয়ে মুনাফা করে তা আবার সুদে আসলে ব্যাংকের ফেরত দিতে হবে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ চাহিদা না বাড়লে বিনিয়োগকারীর উৎপাদিত পণ্য অবিক্রীত থেকে যাবে। এ কারণেই প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এখন বিনিয়োগ নিতে চাচ্ছেন না। এর ফলে ব্যাংকে এখন উদ্বৃত্ত তারল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, এ কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। আর সে জন্য আয় করে ছাড় দেয়াসহ নানা উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়লে অর্থনীতির চাকাও গতি ফিরে পাবে, কোম্পানিগুলোর অবস্থা ভালো হবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই বিদেশীরা আবারো এ দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বিদেশীরা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করে থাকেন। যেসব কোম্পানিগুলোতে আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী ওই সব কোম্পানিগুলোই বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে বিনিয়োগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে থেকেই তাদের শেয়ার ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। সাধারণত স্বাভাবিক অবস্থার সময় বিদেশীরা বেশি হারে বিনিয়োগ করে থাকেন। সেই ক্ষেত্রে গত বছরের ডিসেম্বরের পর থেকেই বিদেশীদের বিনিয়োগ কমতে থাকে। এক পর্যায়ে প্রকৃত বিনিয়োগ শূন্যে নেমে আসে। এর পর থেকেই বিদ্যমান বিনিয়োগে তারা হাত দেয়। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও কয়েক দফায় বিদেশীদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের নীতিমালা শিথিল করে। সবমিলেই সহজেই তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করার সুযোগ পায়। সাধারণত বিদেশী বিনিয়োগ বাড়লে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর লেনদেন যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে অর্থের প্রবাহ। কিন্তু প্রত্যাহারের হার বেড়ে যাওয়ায় টাকার প্রবাহ কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে পুঁজিবাজারে বিদেশীদের নিট বিনিয়োগ ছিল ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার, সেখানে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নিট বিনিয়োগ না বেড়ে বরং কমে যায় ১৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) তা আরো কমে যায় ১৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারে। অর্থাৎ এক মাসে নিট প্রত্যাহার হয়েছে ১৩ লাখ ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিদেশীরা যেভাবে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন, তাতে অনেক কোম্পানিই বেকায়দায় পড়ে যাবে। কারণ, কোম্পানিগুলো পুঁজির সঙ্কটে ভুগবেন। এ থেকে উত্তরণের জন্য বিকল্প বিনিয়োগের দিকে যেতে হবে কোম্পানিগুলোকে।
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১