আমানতের সুদহার হ্রাসের প্রভাব পড়ছে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ে

ব্যাংকবীমাবিডি || ২০২০-১২-১৭ ১১:০৮:৩৮

image

দুঃসময় পার করছেন ব্যাংকের আমানতকারীরা। যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন তারা ব্যাংকে আমানত রেখে কম মুনাফা পাচ্ছেন। মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় ব্যাংকে টাকা রেখে লোকসান গুনছেন তারা। ১৭ ব্যাংকের আমানতের মুনাফার হার ব্যাংক রেটেরও নিচে নেমে গেছে। তবে, আমানতকারীরা বঞ্চিত হলেও তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তিতে রয়েছেন ব্যাংকাররা। মুনাফার হার তলানিতে নেমে যাওয়ায় কমে গেছে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়।

জানা গেছে, ব্যাংকঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনার জন্য দীর্ঘ তিন বছর ধরে নানাভাবে চেষ্টা করে আসছিলেন নীতিনির্ধারকরা। এটাকে সামনে রেখে ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যাংকাররা বিভিন্ন সময়ে নানা সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, একই পরিবার থেকে দু’জন ব্যাংক পরিচালকের পরিবর্তে চারজন করে ব্যাংককে পরিবারের নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা করা, ব্যাংক চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের মেয়াদ দুই মেয়াদের পরিবর্তে তিন মেয়াদ করা (প্রতি মেয়াদে তিন বছর করে একটানা ৯ বছর), সরকারি আমানতের অর্ধেক নিজেদের ব্যাংকে রাখার অধিকার দেয়া, করপোরেট ট্যাক্সে ছাড়, ব্যাংকগুলোর বাধ্যতামূলকভাবে নগদ জমার হার কমিয়ে আনাসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নেন ব্যাংক পরিচালক ও ব্যাংকাররা। এ সুবিধা নেয়া শুরু হয় সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের শেষ আমল থেকে। এটা অব্যাহত থাকে গত এপ্রিলের আগ পর্যন্ত। কিন্তু কোনোভাবেই ব্যাংকের ঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনা যায়নি। সর্বশেষ নয়-ছয় ফর্মুলা আনা হয়। অর্থাৎ ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হলে আমানতের সুদহার আগে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। আমানতের সুদহারও এক পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যাংক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু ঋণের সুদহার অধরাই থেকে যায়।

সর্বশেষ অনেকটা চাপ প্রয়োগ করে ঋণের সুদহার গত ১ এপ্রিল থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ৯ শতাংশ কার্যকর করা হয়। তখন আমানতের সুদহার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে উহ্য রাখা হয়। অর্থাৎ আমানতের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর স্বাধীনতা দেয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত এপ্রিল থেকে ব্যাংকগুলো বাধ্যতামূলকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ঋণের সুদহার ৯ অঙ্কে নামিয়ে আনা হয়েছে, কিন্তু এর বিপরীতে আমানতের সুদহার তলানিতে নামিয়ে আনা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত অক্টোবর শেষে আমানতের গড় সুদহার নেমে এসেছে ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশে। কিন্তু এর মধ্যে ১৭টি ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার ৪ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। এর মধ্যে কোনো কোনো ব্যাংকের গড় আমানতের সুদহার ২ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। যেখানে ব্যাংক রেট রয়েছে ৪ শতাংশ। আর ১৩টি ব্যাংকের আমানতের সুদহার ৫ শতাংশেরও নিচে রয়েছে।

ব্যাংকের আমানতের সুদহার তলানিতে নেমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমানতকারীরা। গড় আমানতের সুদহার এখন মূল্যস্ফীতিরও নিচে নেমে গেছে। গত নভেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। এক দিকে পণ্যমূল্য বেড়ে গেছে, বেড়ে গেছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। কিন্তু সেখানে নানাভাবে কমে গেছে মানুষের আয়। গত মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় অনেক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন অনেক কর্মক্ষম শ্রমিক। অপর দিকে যেসব প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে ওইসব প্রতিষ্ঠানেরও শতভাগ উৎপাদন হচ্ছে না। এতে চালু কারখানা থেকেও অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। আবার যাদের চাকরি আছে তাদের বেতনভাতাও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। এভাবেই মানুষের আয় কমে গেছে। কিন্তু ব্যয়ের খাত খুব একটা কমেনি, বরং ক্ষেত্রবিশেষ বেড়ে গেছে। এ সময়ে মহাবিপাকে পড়েছেন সাধারণ গ্রাহক। তারা না পারছেন ব্যয় কমাতে, না পারছেন টিকে থাকতে। এতে বেশির ভাগই ব্যয় সঙ্কোচন করে চলছেন। যারা একেবারেই টিকতে পারছেন না তারা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আমানতের সুদহার কমিয়ে আনা না হলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় সমন্বয় করা যেতো না। এমনিতেই খেলাপি ঋণের কারণে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেছে, সেই সাথে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনায় তাদের সামনে আমানতের সুদহার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। তবে, সামনে এ পরিস্থিতি ধরে রাখা যাবে না। সামনে ব্যাংকগুলোকে এ হার সংশোধন করতে হবে, অন্যথায় আমানত ব্যাংক থেকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাবেন গ্রাহকরা। তখন বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাবে ব্যাংকগুলোর।

অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com

ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১