খেলাপি ঋণের বেশির ভাগই মন্দ বা আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে। জুন শেষে ৯৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকাই এ মন্দ ঋণ। হিসাব মতে খেলাপি ঋণের ৮৫ শতাংশই মন্দ ঋণ। একেতো করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, ব্যবসা মন্দা, বিনিয়োগ স্থবিরতার পাশাপাশি মন্দ মানের খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকিং খাতে অস্বাভাবিক হারে আয় কমে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের কারণে শুধু জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে সুদ আয় স্থগিত করা হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের আয় কমেছে ৬ হাজার কোটি টাকা। আদায় অযোগ্য ঋণ অর্থাৎ মন্দ ঋণের আধিক্য বাড়ার কারণে সামনে এর প্রভাব আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকারোা।
এ দিকে মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকের আয় থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে না, যে পরিমাণ মুনাফা করেছিল তা দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণও করতে পারছে না অনেক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, জুন শেষে এমন ১১টি ব্যাংক তাদের আয় দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। বরং তাদের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকারোা জানিয়েছেন, ব্যাংকের আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। ঋণগ্রহীতাদের একটি অংশ নানা প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু পরিশোধ করছেন না। এক পর্যায়ে ওই ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এসব খেলাপি ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালাও শিথিল করা হচ্ছে। কখনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়ে, কখনো ১ বা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়ন করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরাও ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। এ দিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গত বছরের জানুয়ারি থেকে ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা দিয়ে আসছে, যা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চলমান থাকবে। প্রথমে বলা হয়েছিল কেউ ঋণ পরিশোধ না করলে খেলাপি করা যাবে না। ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বকেয়া কিস্তির একটি অংশ পরিশোধ করা হলেই তাকে আর খেলাপি করা যাবে না। এ কারণে খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকার মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়ে জুন শেষে। তবে ঋণ আদায়ের শিথিলতা না থাকলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যাবে বলে ব্যাংকারোা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুনে ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে বেশির ভাগ অর্থাৎ ৮৮ হাজার ২২৭ কোটি টাকার ঋণই মন্দ বা কুঋণে পরিণত হয়েছে, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। মন্দ ঋণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আদায় হয় না। এক পর্যায়ে এ ঋণ অবলোপন বা খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে আলাদা করে রাখা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, মন্দ ঋণের বিপরীতে ধার্য্যকৃত মুনাফা বা সুদ ব্যাংকগুলো আয় হিসেবে দেখাতে পারে না। এসব সুদ বা মুনাফা ব্যাংকের আয় খাত থেকে আলাদা করে রাখা হয়। অপর দিকে, মন্দ ঋণ ঝুঁকি ভিত্তিক সম্পদ হিসাবে ধরা হয়। আর এ ঝুঁকি ভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। প্রভিশন হলো আমানতকারীদের আমানত সুক্ষা করতে সংরক্ষিত অর্থ। একে নিরাপত্তা সঞ্চিতিও বলা হয়। প্রভিশন ঘাটতি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলোর জরিমানা বা তিরস্কার গুনতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিরস্কার বা জরিমানার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে অর্থাৎ মুনাফা থেকে প্রভিশন ঘাটতি পূরণ করে থাকে।
এর ফলে এক দিকে ব্যাংকগুলোর মুনাফার পরিমাণ যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি সাধারণ শেয়ার হোল্ডাররাও বছর শেষে প্রকৃত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের বিপরীতে টাকা আটকে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। কারণ, ঋণ আদায় হলে ওই ঋণ আবার ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু ঋণ আদায় না হলে ব্যাংকগুলো ওই অর্থ আর পুনঃবিনিয়োগ করতে পারে না। এভাবে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে যায়। আবার এ মন্দ ঋণের বিপরীতে সুদ স্থগিত করায় ব্যাংকের আয়ও কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ৩০ জুনভিত্তিক খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ স্থগিত করা হয়েছে সরকারি মালিকানাধীন ৬ ব্যাংকের। ব্যাংক ৬টিতে আলোচ্য সময়ে ১৮ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকার সুদ আয় স্থগিত করা হয়েছে। আর ৪১টি বেসরকারি খাতের ব্যাংক মন্দ ঋণের বিপরীতে সুদ আয় স্থগিত করা হয়েছে ১৮ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। ৯টি বিদেশী ব্যাংক সুদ আয় স্থগিত করেছে ৩৪৭ কোটি টাকা এবং দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক ১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকার সুদ আয় স্থগিত করেছে।
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১