সরকারি ব্যাংকে একীভূত হতে চায় পদ্মা ব্যাংক

ব্যাংকবীমাবিডি || ২০২১-০৯-০২ ২৩:৩০:৫৪

image

নানা কারণে আলোচিত পদ্মা ব্যাংক টাকার অভাবে পড়ে সরকারি কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার যে প্রস্তাব সরকারকে দিয়েছে, তা মন্ত্রণালয়ের হাত ঘুরে পৌঁছেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেন, “পদ্মা ব্যাংককে সরকারি ব্যাংকের সাথে মার্জার বা অ্যাকুইজেশনের একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনও নেয়নি।”

অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবতে বসা ফারমার্স ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে। সে সময় চাপের মুখে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর।

পরের বছর ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, যিনি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজেমেন্ট পিএলসি এবং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান।

সে সময় পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধার করতে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংক, যা ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশ।

কিন্তু টাকার অভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হিমশিম খাওয়া এ ব্যাংক এখন আবার সরকারের কাছে নতুন আবেদন করেছে।

টিকে থাকার জন্য পদ্মা ব্যাংক এখন সরকারি ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করতে চাইছে। আর তা না হলে সরকারি কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ওই আবেদনে।

পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. এহসান খসরু গত ৮ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ওই আবেদন করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদ বলেন, “পদ্মা ব্যাংকের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে পুনর্গঠনের একটি আবেদন অর্থমন্ত্রণালয়ে এসেছে।... তবে এই মুহূর্তে ওই আবেদন নিয়ে বলার মত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।”

যাত্রা শুরুর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক দেউলিয়া হতে বসেছিল ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে। গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এ ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হয়, পুনর্গঠন করা হয় পরিচালনা পর্ষদ। ব্যাংকের নাম বদলে হয় পদ্মা ব্যাংক।

সরকারের উদ্যোগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) মিলে পদ্মা ব্যাংকের মালিকানার বেশিরভাগ অংশ কিনে নেয়। সেজন্য ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন যোগাতে হয়।

কিন্তু তাতেও যে পদ্মা ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, অর্থ মন্ত্রণালয়ে লেখা এহসান খসরুর চিঠিতেই তা স্পষ্ট।

সেখানে বলা হয়েছে, সরকারি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া ৭১৫ কোটি টাকার মুলধন দিয়ে পদ্মা ব্যাংক ‘ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা’ করছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ব্যাংক খাত ‘মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়’ তারা মূলধন সঙ্কটে পড়েছে।

এহসান খসরু চিঠিতে বলেছেন, পদ্মা ব্যাংক বর্তমানে যে আয় করছে, তার চেয়ে ব্যায় বেশি হচ্ছে।

২০২০ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের হিসাব তুলে ধরে চিঠিতে বলা হয়, ৫ হাজার ৬২২ কোটি টাকার সম্পদের বিপরীতে পদ্মা ব্যাংককে সুদ দিতে হচ্ছে। আর তাদের আয় হচ্ছে ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার সম্পদ থেকে। ফলে ২০২০ সালে ব্যাংকের ১৬০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।

২০২১ সালে জুন পর্যন্ত সময়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার চিত্র দেওয়া হয়েছে চিঠিতে। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে ১২০ কোটি টাকা পরিচালন লোকসান হয়েছে পদ্মা ব্যাংকের। যার মধ্যে ৭১ কোটি টাকা নিট সুদের মার্জিন।

আর এভাবে লাকসান করতে থাকায় ব্যাংকের মূলধন কমে যাচ্ছে।

চিঠিতে জানানো হয়েছে ২০১৯ সালে পদ্মা ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারস ইকুইটি ছিল ৪৮৭ কোটি টাকা। ২০২০ সালে সেটা কমে হয়েছে ৩৩২ কোটি টাকা। আর ২০২১ সালের প্রথম ৬ মাসে তা আরও কমে ২২১ কোটি টাকা হয়েছে।

এভাবে চলতে থাকলে ২০২১ সালের শেষে শেয়ারহোল্ডারস ইকুইটি ১০০ কোটি টাকার নিচে চলে আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।  

শেয়ারহোল্ডারস ইকুইটি হচ্ছে সমস্ত দায় পরিশোধ করার পর মালিকরা যে টাকা পায়।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জুন মাসে এসে পদ্মা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২১০০ কোটি টাকা।    

একটি ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারণ করে দেওয়া হারে মূলধন সংরক্ষণ রাখতে হয়। কোনো ব্যাংক ওই পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

এ অবস্থায় ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে সরকারকে দুই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছেন পদ্মা ব্যাংকের এমডি।

তার প্রথম প্রস্তাব হল, পদ্মা ব্যাংকে বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের যে আমানত আছে, তার একটি অংশকে ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে’ শেয়ারে রূপান্তর করা।

ন্যূনতম মূলধন পর্যাপ্ততা রক্ষার জন্য পদ্মা ব্যাংকের দরকার ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রাধিকার শেয়ার ইস্যু করে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা এবং অতিরিক্ত সাব–অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যু করে বাকি ৬০০ কোটি টাকার যোগান পাওয়ার পথ বাৎলেছেন তিনি।

চিঠিতে পদ্মা ব্যাংকের এমডি এহসান খসরু বলেন, পদ্মা ব্যাংককে দ্রুত সময়ে সোনালী, জনতা, অগ্রণী বা রূপালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। এর বাইরে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) সঙ্গেও একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।

কিন্তু মূলধন পুনর্গঠন ‘যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ এবং জটিল’ বিষয় হওয়ায় দ্বিতীয় প্রস্তাবে ‘মার্জার বা অ্যাকুইজিশনের’ কথা বলেছেন পদ্মা ব্যাংকের এমডি।

চিঠিতে বলা হয়, পদ্মা ব্যাংককে ‘অনতিবিলম্বে’ সোনালী, জনতা, অগ্রণী বা রূপালী ব্যাংকের মত অংশীদার কোনো ব্যাংক, কিংবা বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) মত কোনো সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত বা অধিগ্রহণ করা যেতে পারে।

ওই চিঠি এবং ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতির কারণ জানতে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. এহসান খসরুকে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। এসএমএস করে কথা বলতে চাইলেও তিনি সাড়া দেননি।

এদিকে যে ব্যাংকগুলো এর আগে পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিল, একীভূতকরণ প্রস্তাবের বিষয়ে তারা কিছুই জানে না।

সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, “সরকারি ব্যাংকের সাথে পদ্মা ব্যাংকের মার্জার বা অ্যাকুইজেশনের বিষয়ে আমরা কোনো চিঠি পাইনি। বিষয়টি আমরা জানি না। এ বিষয়ে আমাদের বোর্ডেও কোনো আলাপ হয়নি।”

পদ্মা ব্যাংকের প্রস্তাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো সুপারিশ করেছে কি না জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলামের কাছে।

জবাবে তিনি বলেন,“অর্থ মন্ত্রণালয় আবেদনটি পেয়ে বিষয়টি আমাদের কাছে ফরোয়ার্ড করেছে। এখন বিষয়টি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ হবে, তারপর সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু ইমিডিয়েটলি আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি না।”

এপ্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি বলেছেন, ব্যাংক লাইসেন্স নেয় ব্যবসা করার জন্য। এটা সামাজিক সেবার জন্য নয়। ব্যাংকটি ব্যবসা করতে না পারলে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। দুনিয়াজুড়ে এটাই একমাত্র নিয়ম। ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান হলে সরকার বিশেষ কারণে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, যদি ওই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলে সমাজে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তখন সরকার চিন্তা করতে পারে। কিন্তু এটা কখনো ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না।

কিন্তু আমরা দেখছি পদ্মা ব্যাংককে এভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন দিয়েছে। এরপরও ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। এটাকে এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মরতে দেওয়া উচিত।

কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখলে অন্য ব্যাংকগুলো একইভাবে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়বে। পরে সরকারের ওপর ভর করে টিকে থাকার চেষ্টা করবে। এমন ব্যাংককে মরতে দিলে অন্য ব্যাংকগুলো একটা বার্তা পাবে। ফলে ব্যাংক খাত ঠিক করার জন্য ব্যাংক মরতে দেওয়া একটা ভালো বার্তা হতে পারে।

অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com

ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১