আমানতের সুদহার নির্ধারণঃ চাপের ব্যাংক খাত

ব্যাংকবীমাবিডি || ২০২১-০৮-১০ ২১:৪৮:৫৩

image

আমানতের সুদহার বেঁধে দেয়ার পরিচালন আয় নিয়ে চাপের মুখে পড়েছে ব্যাংক খাত। অলস অর্থের আধিক্যের কারণেই এমনিতেই তহবিল পরিচালন ব্যয় বেড়ে গেছে, এরপরও নতুন করে সুদহার বেঁধে দেয়ায় এ ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। পরিচালন ব্যয় নির্বাহের পর বছর শেষে বেশিরভাগ ব্যাংকের নেট ঋণাত্মক হতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা। এমনি পরিস্থিতি ব্যাংকার্স সভা ডেকেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আজ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুষ্ঠেয় এ সভায় গভর্নরের কাছে ব্যাংকের সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরবেন এমডিরা। তারা এ থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা চাইবেন। কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর সাথে আলাপ করে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, গত প্রায় দেড় বছর যাবত ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করে এমন নির্দেশনা দেয়া হয়। এর ফলে গত বছরের জানুয়ারি থেকে কোনো ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধ না করলেও ওই ব্যবসায়ীকে ঋণখেলাপি করা যাচ্ছে না। এতে ব্যাংক বাস্তবে ঋণ আদায় কমে গেছে। অপরদিকে গত দেড় বছর ধরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশে-বিদেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেছে। এতে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো চালু রয়েছে ওই সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদানও অর্ধেকে নেমে গেছে। ফলে নতুন ঋণের চাহিদা অনেকাংশেই কমে গেছে। আবার ব্যাংকাররাও চলমান পরিস্থিতিতে নতুন ঋণ দিয়ে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। এতে বেসরকারি ঋণ প্রবাহ কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, জুন শেষে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আর ঋণ আমানতের অনুপাতন জুন শেষে নেমে এসেছে ৭২ শতাংশ। যেখানে সর্বোচ্চ সীমা রয়েছে ৮৭ শতাংশ। ঋণ বিতরণ কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর হাতে বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত অর্থ বেড়ে গেছে। জুন শেষে শুধু এসএলআর সংরক্ষণ করার পরেও ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে দুই লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। আর বিধিবদ্ধ নগদ জামার হার অর্থাৎ সিআরআর অতিরিক্ত রয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা।

এ দিকে গত বছরের এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করা হয়। ক্রেডিট কার্ড ছাড়া প্রায় ঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে যখন নামিয়ে আনা হয় তখনও অনেক ব্যাংকই ৮ থেকে ৯ শতাংশ হারে আমানত সংগ্রহ করেছিল। তখন আমানতের সুদহার বেধে দেয়া হয়নি। এর ফলে যেসব ব্যাংকের টাকার সঙ্কট ছিল তাদেরকে বেশি হারেই আমানত সংগ্রহ করতে হয়েছে। ওই সময় বেশির ভাগ ব্যাংকেরই নিট আয় কমে গিয়েছিল। তখন ধীরে ধীরে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনে। কিন্তু করোনার পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হওয়ায় ব্যাংকগুলোর হাতে একদিকে উদ্বৃত্ত তহবিল বাড়তে থাকে, অপরদিকে বিনিয়োগ চাহিদা কমতে থাকে। সব মিলে আবারো তহবিল ব্যবস্থাপনায় চাপে পড়ে যায় ব্যাংকগুলো। এ চাপ সামাল দেয়ার জন্য আমানতের সুদহার ফি মাসেই কমাতে থাকে। এক পর্যায়ে গড় সুদহার ৪ শতাংশে নেমে আসলেও বেশির ভাগ ব্যাংকের এ হার আরো কমে যায়। বিশেষ করে মেয়াদি ঋণের সুদহার ব্যাংকভেদে দুই-আড়াই শতাংশে নামিয়ে আনে। ফলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় অনেক খানিই সমন্বয় হয়।

আমানতের সুদহার কমিয়ে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যান আমানতকারীরা। কারণ মূল্যস্ফীতি যেখানে সাড়ে ৫ শতাংশ, সেখানে আমানের গড় সুদহার ৪ শতাংশে নেমে আসায় প্রকৃত আয় তাদের ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। বেশি মুনাফার আশায় আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করতে থাকে। অনেকেই বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক বছর পর আমানতের সুদহারের ওপরও হস্তক্ষেপ করে। এরই অংশ হিসেবে গত রোববার তিন মেয়াদি ও তার ঊর্ধ্বে আমানতের সুদহার বেঁধে দেয়া হয়। বলা হয়, এসব আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির কম নির্ধারণ করা যাবে না। এমনি পরিস্থিতিতে আরেক দফা চাপে পড়ার আশংকা করছেন এমডিরা।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, এমনিতেই ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়েছিল। আমানতের সুদহার কমিয়ে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় সমন্বয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির উপরে আমানতের সুদহার বেঁধে দিতে হলে কমপক্ষে সাড়ে ৫ শতাংশের ওপরে নির্ধারণ করতে হবে। একদিকে অলস অর্থ, অপরদিকে খেলাপি ঋণের আধিক্য, সাথে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার সব মিলেই ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতে আজ বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠেয় ব্যাংকার্স সভায় গভর্নরের কাছে এসব বিষয় তুলে ধরবেন এমডিরা। এ থেকে উত্তরণের জন্য গভর্নরের কাছে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা চাইবেন। আজকের ব্যাংকার্স সভায় সভাপতিত্ব করবেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবির। সভায় প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। সভায় সমসাময়িক ব্যাংকিং খাত নিয়ে সার্বিক পর্যালোচনা করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com

ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১