করোনার প্রভাবে ব্যাংকগুলো নতুন কোনো বিনিয়োগে যাচ্ছে না। যেটুকু বিনিয়োগ করা হচ্ছে তার বেশির ভাগই বিদ্যমান উদ্যোক্তাদের মাঝে চলতি মূলধনের জোগান দেয়া হচ্ছে। ফলে ঋণ-আমানতের অনুপাতের নিচে নেমে গেছে বেশির ভাগ ব্যাংকের বিনিয়োগ। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ঋণ আদায় হচ্ছে না। এতে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ছে পুঞ্জীভূত সুদ। সুদই আবার মূল ঋণের সাথে যুক্ত হচ্ছে। নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাংকের বিনিয়োগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ঋণ-আমানত অনুপাতের অনেক নিচে নেমে গেছে। নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় এক দিকে ব্যাংকের মুনাফা বাড়ছে না। অপরদিকে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এতে বছর শেষে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সংশয় দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, কিছু কিছু ব্যাংক ব্যবসায়ীদের ঋণ দিচ্ছে না। তারা ব্যবসায়ীদের ঋণ না দিয়ে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বেশি বিনিয়োগ করছে। এ কারণে অনেক প্রকৃত ব্যবসায়ী ঋণের অভাবে ব্যবসা চালাতে পারছেন না। কেউ কেউ তহবিলের অভাবে ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন। চলমান অবস্থায় বেসরকারি খাতে ঋণের গতি ব্যাংকগুলো আপনাআপনি শ্লথ করায় ঋণের প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের গতি থেমে যাচ্ছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়ায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এতে অনেক কর্মক্ষম শ্রমিক কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, দেশে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হাতেগোনা বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধ করতে চান। কিন্তু চলমান অবস্থায় ব্যবসার গতি শ্লথ হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী তহবিলের অভাবে ব্যবসা চালিয়ে নিতে পারছেন না। এতে প্রকৃতপক্ষেই একধরনের ব্যবসায়ী ব্যাংকের খাতায় খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। তাদের টিকিয়ে রাখতে তহবিল জোগান দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যাংক থেকে এ ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারবে তার সীমা বেঁধে দেয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। আগে প্রতিটি ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পারতো মোট আমানতের ৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা আমানত নিয়ে ৮৫ টাকা বিনিয়োগ করতে পারতো। ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়া হয়। বলা হয়, প্রচলিত ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানতের ৮৭ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে। অপর দিকে ইসলামী শরিয়া আইনে পরিচালিত ব্যাংকগুলো ৯২ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগেরই ঋণ-আমানতের অনুপাত ৮০ শতাংশের নিচে রয়েছে। আর সরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানতের অনুপাত রয়েছে ৭০ শতাংশের নিচে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে বেশির ভাগ ব্যাংকই বিনিয়োগে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। কারণ, করোনার প্রভাবে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশে পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এতে শিল্পকারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা-সম্প্রসারণ করছেন না। তারা চলমান ব্যবসাই টিকে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক। ফলে নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে না। তবে, যেটুকু ঋণ বাড়ছে তার বেশির ভাগই বিদ্যমান ঋণের ওপর সুদ যুক্ত হয়ে বাড়ছে।
একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানান, প্রকৃত ঋণ না বাড়লেও আপনাআপনি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে পুঞ্জীভূত প্রায় সাড়ে ১১ লাখ কোটি টাকার ঋণ আছে। প্রতি মাসেই এ ঋণের ওপর ৯ শতাংশ সুদ আরোপ করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করলে এতে সুদ আদায় হতো। সুদ সঞ্চিতি হতো না। কিন্তু ঋণ আদায় না হওয়ায় সাড়ে ১১ লাখ কোটি টাকা ঋণের ওপর ৯ শতাংশ হারে সুদ আরোপ হয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে ঋণের যে প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে তা প্রকৃত নয়, কৃত্রিম প্রবৃদ্ধি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। প্রতি মাসে সঞ্চিতি ঋণের সুদ বাদ দিলে প্রকৃত ঋণ প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে যাবে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ে। কারণ, ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তারা নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করেন। এতে বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। ফলে তা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কিন্তু নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বছর শেষে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে। এ কারণে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করে তাদের মধ্যে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ব্যাংকারদের চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনই বাধাগ্রস্ত হবে না, মুনাফা কমে দুর্বল হয়ে পড়বে ব্যাংকিং খাত।
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১