গত বছর বছরের মার্চ থেকে আঘাত হানা করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মারাত্নক অচলাবস্থা তৈরি করে। বছরের প্রথমার্ধ এবং ষান্মাসিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফায় মারাত্নক ধ্বস নামে। আগে থেকেই খেলাপি ঋণের চাপ, তারল্য সংকট এর ওপর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতির হওয়াও পরিচালন মুনাফা হ্রাসে ভুমিকা রাখে। অন্যদিকে, ১লা এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনাও মুনাফা ধসের অন্যতম কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। গতবছরের অতিমহামারি করোনার করুণ অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এ বছর দ্বিতীয় দফা সংক্রমণে অর্থনীতি তথা আর্থিক খাত রীতিমতো নাস্তানাবুদ।
করোনায় মহামারীতে চরম অস্থিরতা তৈরি হয়েছে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থায়। করোনা ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণের জন্য গত বছর দেশে মোট ৬৬ দিন লকডাউন ছিল। এ বছর আবারও করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার গত ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন এবং ১৪ তারিখ থেকে সর্বাত্নক কঠোর লকডাউন ও সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সাধারণ ছুটি ঘোষনা করেছে যা এখন পর্যন্ত চলমান আছে।
করোনাভাইরাসের আঘাতে গত বছর ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায়ও বড় ধাক্কা লাগে। এ সময়ে বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমে যায়। বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, প্রায় ১৬টি বেসরকারী ব্যাংকের মুনাফা পূর্বপর্তী বছরের তুলনায় ১০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। অল্প কয়েকটি ব্যাংক মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
মহামারী করোনার কারণে গত বছর ব্যাংকগুলোকে বড় ধরনের ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন দফায় গ্রাহকদের বিশেষ ছাড় দেয়ার কারণে গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করা হয়। দ্বিতীয় ঢেউয়ের নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় চলতি বছর আবারও ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী আপাতত ঋণ শোধ না করলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন না। তবে যেসব চলমান ঋণের মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে এবং নতুন করে নবায়ন করা হয়নি, এসব ঋণের শুধু সুদ পরিশোধ করলেই ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত নিয়মিত রাখতে হবে।এসব গ্রাহকের কেউ ২০২০ সালের সুদ বকেয়া থাকলে চলতি মার্চ থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে ৬টি কিস্তির ত্রৈমাসিক কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করতে পারবেন। একই সঙ্গে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত যে সুদ আসে, তা–ও ত্রৈমাসিক কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। আগে চলমান ঋণের কিস্তি প্রতি মাসে পরিশোধ করতে হতো।এ ছাড়া তলবি ঋণ চলতি মার্চ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করা যাবে। এভাবে শোধ হলে খেলাপি করা যাবে না।কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, কোনো ত্রৈমাসিকে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে বিশেষ সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে। ওই ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
পাশাপাশি গত বছরে যাঁরা কিস্তি না দিয়েও খেলাপি হননি, এমন মেয়াদি ঋণের মার্চের কিস্তি জুন মাসের মধ্যে পরিশোধ হলেও খেলাপি হিসেবে দেখানো যাবে না। এর ফলে চলতি মার্চে কেউ কিস্তি না দিলেও খেলাপি হবেন না। পাশাপাশি চলমান ঋণের সুদ পরিশোধ করলেই খেলাপিমুক্ত থাকা যাবে।
এ বছর প্রথম ব্যাংক খাতে চাঞ্চল্য ফিরে আসছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কায় ব্যাংকগুলোর ক্ষতি কোথায় নিয়ে যায় তা নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যে উৎকন্ঠা তৈরি হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে ঋণ খেলাপি হওয়া ঠেকিয়ে রাখার সুযোগ নিয়েছেন ঋণ পরিশোধে অক্ষমদের পাশাপাশি সক্ষমরাও। ফলে বিদায়ী বছরে ব্যাংকের নগদ আদায় ব্যাপকভাবে কমে যায়। আবার যারা ব্যাংকে আমানত রেখেছিলেন, তাদের অনেকেই তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে ব্যাংক থেকে আমানত প্রত্যাহার করেন। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এক দিকে ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত আসছে না, অন্য দিকে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।ফলে ব্যাংকারদেরকে বাড়তি চাপে পড়তে হচ্ছে। সময় বাড়িয়ে খেলাপি ঋণ দির্ঘায়িত করার ফলে প্রকৃত আয় না বাড়লেও কৃত্রিমভাবে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকের মুনাফা। কৃত্রিম মুনাফা বেড়ে যাওয়ায় এক দিকে এ মুনাফার ওপর সরকারকে কর পরিশোধ করতে হবে। এতে জনগণের সম্পদ সরকারের কোষাগারে চলে যাবে। অপর দিকে কৃত্রিম মুনাফার ওপর ভিত্তি করে লভ্যাংশ বণ্টন হলে ব্যাংকের মূলধনের গুণগত মান কমে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে।
ঋণ আদায় না হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে সংশ্লিষ্ট ঋণকে খেলাপিও করা যাচ্ছেনা। অর্থাৎ এসব খেলাপি ঋণ ব্যাংকের খাতায় নিয়মিতই থেকে যায়। ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করার সংস্কৃতি চালু হওয়ায় যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন ।ফলে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বুঝা যাচ্ছেনা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,দীর্ঘ মেয়াদী ছাড়ের ফলে দেশে খেলাপি ঋণের পাহাড় তৈরি হচ্ছে যা ভবিষ্যতে ব্যাংকারদের জন্য বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় শক্তি প্রবাসী আয়। করোনার প্রথম ধাক্কায় প্রবাসী আয় না কমলেও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমিক যাওয়া ব্যাপক কমেছে। ফলে মাসওয়ারি ভিত্তিতে প্রবাসী আয় কমতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় ধাক্কায় পরিস্থিতি আরও বেগতিক হতে পারে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত আগের বছরের তুলনায় প্রবাসে শ্রমিক যাওয়া কমেছে ৭১ শতাংশ। ফলে ভবিষ্যতে এর নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে পারে।
প্রণোদনার ঋণ বিতরণ শুরু করে শেষ করোনার প্রথম ধাক্কা কটিয়ে উঠার চেষ্টা করেছিল ব্যাংকগুলো। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিল মাসের ৫ তারিখ থেকে শুরু হওয়া লকডাউনে বন্ধ হয়েছে সব ধরনের ব্যবসা বাণিজ্যে, পর্যটন এলাকা এবং সকল প্রকার যানবাহন চলাচল। তবে সীমিত আকারের চলছে ব্যাংকিং ও অন্যান্য অফিসের কার্যক্রম। নতুন করে শুরু হওয়া করোনার পরিস্থিতি অর্থনীতিকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। তবে ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক ধরনের শংকা তৈরি হয়েছে হয়েছে।
আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার প্রত্যাশা করেছিল ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা। ব্যবসায়ীলা এবছর ঈদ কেন্দ্রীক অধিক সংখ্যক মালামাল দোকানে তুলেছে যাতে গত বছরের লোকসান কিছুটা হলেও সমন্বয় করা যায়। সেসাথে সরকার ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করার পর করোনা নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য ফিরে আশার প্রত্যাশা করা হয়েছিল। কিন্তু লকডাউনের কারনে ব্যবসা বাণিজ্যের গতি ফিরে আসছেনা।
গত বছর জুড়েই ব্যাংকারদের মধ্যে ছাঁটাই আতঙ্ক, বেতন ভাতা হ্রাস সহ নানামুখী চাপ, উৎকন্ঠা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটছিল । এখনো কয়েকটি ব্যাংকে হ্রসকৃত বেতন ভাতা চলমান আছে। ২০২১ সালটিকে সামগ্রিক অর্থনীতি তথা ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়ানোর বছর হিসাবে মনে করা হয়েছিল।সে লক্ষ্যে চলতি বছরের শুরু থেকেই ব্যাংকের মুনাফা ইতিবাচক ধারায় ফিরে আনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল ব্যাংকাররা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ও অর্থনীতি স্বাভাবিক না হলে ব্যবসায়ীরা ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারবেনা। ফলে অনেক ব্যাংক নতুন বিনিয়োগের সক্ষমতা হারাতে পারে। যা স্বাভাবিক ব্যাংকিং পরিচালনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত নিয়ে তা অপেক্ষাকৃত বেশি মুনাফায় আবার উদ্যোক্তাদের মাঝে বিনিয়োগ করেন। নির্ধারিত সময় শেষে আমানতকারীদের অর্থ মুনাফাসহ ব্যাংককে ঠিকই পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু ঋণগ্রহীতারা ঋণের অর্থ ফেরত না দিলে বেকায়দায় পড়ে যায় ব্যাংকিং খাত। গত বছর কোনো অর্থ পরিশোধ ঋণগ্রহীতারা পরিশোধ না করেই পার করেন। তাদের অনুরোধ এ সুযোগ আরো ছয় মাস অর্থাৎ জুন মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এভাবে ঋণের অর্থ ফেরত না এলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া ব্যাংকের কঠিন হয়ে পড়বে, কমে যাবে ব্যাংকের আয়। সব মিলিয়েই করোনা ও দেশের অর্থনীতি পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তার দিকে ব্যাংকারদেরকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যাংক খাততে এগিয়ে নিতে হবে।
লেখকঃ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ইমেইলঃ ma_masum@yahoo.com
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১