করোনা মহামারিকালে দেশের অর্থনীতির সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে বুক চেতিয়ে কাজ করে গেছেন ব্যাংকাররা। যখন সারাদেশে সাধারণ ছুটি ও লকডাউন চলেছে তখনও নিজের ও পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন তারা। কর্মস্থলে উপস্থিত হয়ে গ্রাহকদের সেবা দিতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত তিন সহস্রাধিক ব্যাংকার। মোট কতজন মারা গেছেন তার কোনও সঠিক হিসাব না থাকলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়েই আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১২ জন। দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া এই সম্মুখযোদ্ধাদের জন্য ছিল না উল্লেখযোগ্য কোনও প্রণোদনার ব্যবস্থা। যে কারণে ব্যাংকারদের ও তাদের পরিবারের মধ্যে হতাশা ও আতঙ্ক নেমে এসেছিল। তবে এই অবস্থা থেকে তাদের মুক্তি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ঘোষণা। সোমবার প্রজ্ঞাপন জারি করে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কোনো ব্যাংকারের মৃত্যু হলে তার পরিবারকে ২৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর্থিক খাতের অভিভাবক প্রতিষ্ঠানের এই ঘোষণায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে দেশের সব তফসিলী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর কাছে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, গত বছরের ২৯ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত করোনায় প্রাণ হারানো সব ব্যাংকারের পরিবারই এই ক্ষতিপূরণ পাবে।
সোমবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংক এই প্রজ্ঞাপন জারি করলে ব্যাংকাররা তাদের ফেসবুক পোস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে প্রজ্ঞাপনের ছবি শেয়ার দেয়। মুহূর্তেই এই পোস্টগুলো ভাইরাল হয়ে যায় এবং কমেন্ট বক্সে ও পোস্টে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানায়। এই সার্কুলার জারি করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের কর্মকর্তাদের, বিশেষ করে এই বিভাগের দায়িত্বপালনকারী ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাসেরকে ধন্যবাদ ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেখা যায় অনেক ব্যাংকারকেই।
কয়েকজন ব্যাংকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে করোনা মহামারির মধ্যেও কাজ করতে গিয়ে অনেকেই আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। এতে তাদের পরিবারগুলো অসহায় হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিয়েছে তা তাদেরকে উজ্জীবিত করেছে এবং দেশের জন্য আরও বেশি কাজ করতে উৎসাহীত করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, ‘ব্যাংকে কর্মরত অবস্থায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্ত্রী/স্বামী/সন্তান এবং অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে বাবা/মা ক্ষতিপূরণের অর্থ পাবেন।’ এ নির্দেশনা গত বছরের ২৯ মার্চ থেকে কার্যকর হবে এবং পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
কাদের জন্য কত ক্ষতিপূরণ:
প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, সিনিয়র অফিসার, প্রবেশনারি অফিসার, ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার বা সমমান হতে তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তা মারা গেলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫০ লাখ টাকা পাবেন। ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার বা সমমানের পদমর্যাদার কর্মকর্তারা পাবেন সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। স্টাফ ও সাব-স্টাফের (যেকোনো প্রক্রিয়ায় নিয়োগ/নিয়োজিত) ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ পাবেন ২৫ লাখ টাকা।
প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট করে বলা হয়, কর্মকর্তা বা কর্মচারীর ক্ষেত্রে ব্যাংকে তার অন্য কোনো দায়-দেনা ক্ষতিপূরণের অর্থ দিয়ে সমন্বয় করা যাবে না। এ ক্ষতিপূরণ বর্তমানে প্রচলিত অন্য যেকোনো প্রজ্ঞাপন/আদেশ/নীতিমালায় বর্ণিত কর্মকালীন মৃত্যুবরণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আর্থিক সহায়তা/অনুদানের অতিরিক্ত হিসেবে প্রদেয় হবে।
ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৪২টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক ও নয়টি বিদেশি ব্যাংকসহ বাংলাদেশে মোট তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। করোনাভাইরাসের কারণে সরকারঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যেও সীমিত আকারে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু আছে। এ কারণে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্যাংকে গিয়ে সেবা দিতে হচ্ছে। তাদের ঝুঁকি বিবেচনায় এবং দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ এ নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারি-বেসরকারি সবাইকেই এ নির্দেশনা মানতে হবে।
মহামারি করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে কর্মরতদের আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে। গত ১৫ দিনে পাঁচ শতাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী সংক্রমিত হয়েছেন। আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১২ ব্যাংকার ও একটি ব্যাংকের গাড়িচালক। এছাড়া উপসর্গ দেখা দিয়েছে সহস্রাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর শরীরে।
এই সার্কুলার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাসের বলেন, ‘করোনাকালেও অর্থনীতির চাকা যাতে স্থবির হয়ে না যায় সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নে গত বছর ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলেও সীমিত পরিসরে খোলা ছিল ব্যাংক। করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ শুরু হলে ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন শুরুর পরও ব্যাংক বন্ধ হয়নি। ব্যাংকাররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছেন। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক ব্যাংকার মৃত্যুবরণ করেছেন। এতে তাদের পরিবারগুলো নিরুপায় হয়ে পড়েছে। তাই ব্যাংকারদের জন্য কিছু করার কথা ভাবছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকারদের অবদানের ও ত্যাগের বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও অনুধাবন করতে পেরেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মহোদয়ের সদয় সম্মতিক্রমে ব্যাংকারদের জন্য ক্ষতিপূরণ ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১