করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে ব্যাংকে আবার ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে। বেশির ভাগ ঋণগ্রহীতাই নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ আরো বেড়ে যাচ্ছে। এটা অব্যাহত থাকলে বছর শেষে এবারো ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ব্যাংকাররা জানান, করোনার প্রভাবে গেলো বছর বলা চলে ব্যাংকের ঋণ আদায় তেমন একটা হয়নি। সারা বছরই ঋণ আদায়ের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিলতা ছিল। বলা হয়েছিল কেউ ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তাকে খেলাপি করা যাবে না। এ সুযোগ প্রথমে জুন মাস পর্যন্ত দেয়া হয়। পরে দুই দফা বাড়িয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত টেনে নেয়া হয়। এ কারণে গেলো বছর বিশেষ করে বড় ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে তেমন একটা আদায় হয়নি। ডিসেম্বর শেষে গত জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ আদায়ে শিথিলতা তুলে নেয়। বলা হয়, ঋণ আদায়ের শিথিলতা আর বাড়ানো হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নির্দেশনার ওপর কিছুদিন অনড় থাকার পর গ্রাহকরা ব্যাংকে আসতে শুরু করেন। অনেকেই ঋণ পরিশোধে উদ্যোগী হন। এরই মধ্যে অনেকেই ঋণ পরিশোধ করেন। অনেকে ঋণ পরিশোধ করার উদ্যোগ নেন।
একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানান, জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঋণ আদায়ের গতি বেড়ে যায়। কিন্তু নতুন করে সমস্যা দেখা দেয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে। গত মার্চ থেকে করোনার প্রাদুর্ভাব আবার বাড়তে থাকে। নতুন উদ্যোগে চালু হওয়া সচল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আবারো হোঁচট খেতে থাকে। চলতি মাসের শুরু থেকেই আবার লকডাউনের কবলে পড়ে যায় দেশে শিল্পখাত। বলা হয়, শিল্পখাত লকডাউনের আওতামুক্ত থাকবে। কিন্তু আধা বেলা ব্যাংক খোলা রাখায় ব্যবসায়ীদের স্বাভাবিক লেনদেন বাধাগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া অর্থনীতির অন্যান্য যেসব খাত লকডাউনের কবলে রয়েছে, সেখানে শুধু শিল্পকারখানা খোলা রাখার তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যায় না। ইতোমধ্যে বৈশাখ কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক লেনদেন কার্যত অচল হয়ে পড়ে। এর পরে পবিত্র রমজান কেন্দ্রিক কর্মকা ও স্থাবির রয়েছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ঘুড়ে দাঁড়ানোর যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল তা আবার থেমে যায়। এতে নতুন করে ঋণ আদায়েও ভাটা পড়ে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক ঋণের বড় একটি অংশই চলে গেছে কিছু বড় শিল্প গ্রুপের দখলে। অর্থনীতির সামগ্রিক অবস্থা ভালো থাকলে ওইসব গ্রুপের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হয়। এতে ব্যাংকের ঋণ আদায়ে গতি বাড়ে। কিন্তু অবস্থা খারাপ হলে ব্যাংকের ঋণ আদায়ের ওপরই বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তিনি জানান, নানা কারণে যত সহজে বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে ছোটরা তত সহজে ঋণ নিতে পারে না। এতে ব্যাংকের বিনিয়োগ ছোটদের চেয়ে বড়দের দখলে বেশি চলে যায়। এখানেই আশঙ্কার কারণ। গত বছর যেভাবে করোনার দোহাই দিয়ে ঋণ পরিশোধে বড়রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে শিথিলতা নিয়ে নেয়, এবারো যদি গত বছরের ধারাবাহিকতায় কিছু করা হয়, তাহলে ব্যাংকে এবারো ঋণ আদায় বড় ধরনের হোঁচট খাবে। এতে মুনাফা আরো কমে যাবে। বিশেষ করে ব্যাংক সম্পদের গুণগতমান আরো খারাপ হয়ে যাবে। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে বড়দের চেয়ে ছোট ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের ওপর বেশি জোর দিতে হবে। কারণ ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেন। ওই বিনিয়োগ থেকে অর্জিত আয় দিন শেষে ব্যাংকে ফেরত দেন। বড় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। আবার একজন ছোট ব্যবসায়ীর সমস্যা হলে ব্যাংকের বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু একটি বড় শিল্পগ্রুপ সমস্যায় পড়লে কয়েকটি ব্যাংক একসাথে সমস্যায় পড়ে যায়। এ কারণে অর্থনীতির সামগ্রিক স্বার্থেই ছোট ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা বেশি হারে করতে হবে; অন্যথায় ব্যাংকের খেলাপি ঋণসহ মন্দ ঋণের হার আরো বেড়ে যাবে।
ব্যাংকগুলোর পরিসংখ্যান দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, খেলাপি ঋণের বেশির ভাগই এখন মন্দ মানের। কারণ ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। এ কারণে ঋণখেলাপিরা বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের দেখাদেখি অন্যরাও ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। এ কারণেই ব্যাংকিং খাতের মন্দ মানের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে।
অপর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো মন্দ মানের খেলাপি ঋণ তিন বছরের বেশি অতিবাহিত হলে ওই ঋণ অবলোপন করতে হয়। অবলোপন হলে খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে আলাদা করে ব্যাংকের অন্য হিসাবে রাখতে হয়। ওই ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংককে মামলা করতে হয়। এতে এক দিকে বাড়তি প্রভিশন রাখতে গিয়ে ব্যাংকের আয় কমে যায়, অপর দিকে মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে ব্যাংকের বাড়তি ব্যয় হয়। ব্যাংক খাতের জন্য মন্দ মানের খেলাপি ঋণ একপর্যায়ে শাঁখের করাতের অবস্থা হয়। ব্যাংকাররা জানান, মন্দ মানের খেলাপি ঋণ কমাতে হলে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকিং খাত মন্দ ঋণের অভিশাপ থেকে বের হতে পারবে না বলে তারা মনে করেন।
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১