‘লকডাউনে’ বন্দি এবারের বাংলা নববর্ষ অর্থনীতি

ব্যাংকবীমাবিডি || ২০২১-০৪-১৩ ২২:১০:২৭

image

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/ যাক।

পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে- যাওয়া গীতি/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা নববর্ষকে আবাহন জানিয়েছিলেন এভাবেই। কিন্তু বাঙালির জীবনে গত বছরের মতো এবারও এসেছে অন্যরকম বৈশাখ। এ বৈশাখ উৎসবহীন- মলিন।

চারদিকে বাজছে মৃত্যুর বাজনা, হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রিয় মুখ। করোনা মহামারি বিশ্ববাসীর মতো বাঙালির জীবনও করেছে তছনছ। তবুও আজ আরও একবার পুরনো বছরের জরা-জীর্ণকে পেছনে ফেলে নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প নেবে বাঙালি।

আজ যে পহেলা বৈশাখ। বাঙালির জীবনে আজ নতুন বছরের প্রথম দিন। আজকের সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে সূচনা হলো বাংলা ১৪২৮ সালের। তবে আজকের এই বৈশাখ বাঙালির জীবনের গত বছরের বৈশাখের মতোই। করোনা মহামারির কারণে বৈশ্বিক এই দুর্যোগের সময় আমাদের জীবন অবরুদ্ধ আবারও। ঘরে বসে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে এবারও বাধ্য হচ্ছে বাঙালি। আজও প্রাণে প্রাণ মিলবে রাস্তা বা খোলা ময়দানে নয়, যার যার বাসায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ম্যাসেঞ্জারে।

জনসমাগমে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাংলা নববর্ষ ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরমে বা অনলাইনে উদ্যাপনের নির্দেশ দিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। করোনার ছোবল থেকে বাঁচতে আজ পহেলা বৈশাখ থেকেই শুরু হয়েছে সাত দিনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা।

ফলে এবারও ‘লকডাউনে’ বন্দি বৈশাখী উৎসব ও একে ঘিরে থাকা অর্থনীতি। পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি থাকার পরও গত বছর উদ্যাপন করা যায়নি বৈশাখ, এবারও একই চিত্র। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।

করোনা শুরুর আগের বছর পর্যন্ত চৈত্রের শেষ দিনে দেশীয় পোশাক, মুড়ি-মুড়কি ও খাবারের দোকানে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় থাকত। করোনায় বদলে গেছে সেই চিত্র। মাঝখানে একটা আশা দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত দোকানিরা এবারও ঘরে বসে হিসাব কষছেন লোকসানের। কেননা, ‘লকডাউনে’ অভিজাত শপিংমল থেকে ফুটপাতের দোকান সব বন্ধ।

মফস্সলেও বৈশাখী মেলার উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। ইলিশসহ খাবারের বাণিজ্যেও ধস। বৈশাখী উৎসব ঘিরে এই মৌসুমে ৭-৮ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য এখন পুরোটাই শূন্যের কোঠায়। নারায়ণগঞ্জের তাঁতিপল্লিতে কারিগরদের দম ফেলার সময় থাকত না। এবারও এক ধরনের প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ‘লকডাউনে’ বন্দি সব। একের পর এক অর্ডার বাতিল হওয়ায় মহাজনরাও বিপাকে পড়েছেন।

তাতি, কুমার, শিল্পী ও দেশীয় ফ্যাশনের দোকানিদের পুঁজি হারানো প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি রেজাউল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বৈশাখী বাজার পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন প্রান্তিক, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। কারণ, বৈশাখী বাজার ঘিরে ব্যবসায়ীদের সব ধরনের প্রস্তুতি ছিল।

কিন্তু সবার স্বার্থে দেওয়া ‘লকডাউন’ মেনে নিতেই হবে। তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিলে ক্ষতি অনেকটা কাটিয়ে ওঠা যাবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে বৈশাখী উৎসব বন্ধ ছিল। গত দুবছর ধরে একই অবস্থা বিরাজ করছে। বৈশাখ ও রোজার ঈদের উৎসব মিলিয়ে কয়েক মাস আগে থেকেই বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে রেখেছিলেন তারা। বৈশাখের আয় দিয়ে সারা বছরের কর্মপরিকল্পনা করে থাকেন অনেক ব্যবসায়ী।

লকডাউনের কারণে সব শেষ। রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজমা আখতার পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে এক মাস আগেই প্রস্তুতি নিয়েছেন। নিজের জন্য নতুন শাড়ি, গহনা কেনার পাশাপাশি ছোট বাচ্চা নাফিস ও নাফিসার জন্যও কেনাকাটার প্রস্তুতি ছিল। বাড়িতেও বাঙলা খাবারের বিশেষ আয়োজন ছিল। কিন্তু ‘লকডাউনের’ কারণে বর্ষবরণকে ঘিরে কোনো আয়োজনই আর থাকছে না।

আনন্দটাই মাটি। কথা হয় বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরির সঙ্গে। তিনি বলেন, বৈশাখের উৎসব বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে গ্রামীণ অর্থনীতি। তাঁতি, কুমার, শিল্পী, ছোট দেশীয় পোশাক ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এতে গ্রামীণ পর্যায়ে কর্মসংস্থানের গতি, দারিদ্র্য বিমোচনের হার ও স্বাভাবিক অর্থনীতির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে।

এই উৎসব ঘিরে দেশীয় পোশাকের বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হয়। গ্রামগঞ্জে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মাটির গহনা, গৃহসামগ্রী, মুড়ি-মুড়কি, ইলিশ, দই, মিষ্টি, তরমুজসহ দেশীয় ফলের বাণিজ্যেও ধুম পড়ে। অর্থনীতিতে একশ শতাংশ মূল্য সংযোগ হয়। কিন্তু ‘লকডাউনে’ সবকিছুই বন্ধ হয়ে গেল।

অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com

ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১