আরও ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা চান গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা

ব্যাংকবীমাবিডি || ২০২১-০৪-১০ ২১:৫৯:১৩

image

গত ৫ এপ্রিল থেকে দেশজুড়ে ‘লকডাউন’ চলছে। ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়া করোনার সংক্রমণ কমিয়ে আনতে লকডাউন আরও কঠোরভাবে পালন করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু লকডাউন বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে আছে সংশয়। আর সরকার এবার কী ধরণের লকডাউনে যেতে চাইছে, তা নিয়ে ব্যবসায়ী মহল ও অর্থনীতিবিদরা এখনও অন্ধকারে। সরকারের পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে কিছু বলা হয়নি।

তবে লকডাউন যেমনই হোক, শ্রমিকদের নামে গত বছরের মতো এবারও ১০ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রণোদনা চান গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা। তারা আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে শ্রমিকদের বেতন-ভাতার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা তহবিল নিয়ে অচিরেই সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। এছাড়াও প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, গতবারের মতো দীর্ঘ মেয়াদে গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হলে উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন প্রণোদনার দরকার হবে।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সদ্য নির্বাচিত সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, শ্রমিকদের বেতন বোনাসের জন্য নতুন প্রণোদনার দরকার হবে। সামনে ঈদ। বেতন-বোনাস একসঙ্গে দেওয়া গার্মেন্ট মালিকদের পক্ষে সম্ভব হবে না। ফলে পুরনো প্রণোদনার টাকা ফেরতের জন্য সময় বাড়িয়ে দিতে হবে। নতুন করে আরও দশ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা লাগবে।

তিনি বলেন, এই ১০ হাজার টাকার সবই আমরা শ্রমিকদের সরাসরি দিয়ে দেবো। আর যেভাবে কারখানা চলছে, এভাবে কারখানা চালিয়ে রাখতে পারলে ব্যাংকের টাকাও একদিন পরিশোধ করা যাবে। কিন্তু কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে মালিকরা পথে বসে যাবে।

বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সামনে যেহেতু ঈদ বা রোজা রয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে আমাদের অনেকেরই দেনা রয়েছে। সে জন্য আমাদেরকে নতুন করে শ্রমিকদের বেতন-বোনাসের জন্য অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার নতুন ঋণ সুবিধা দেওয়ার কথা আমরা বলছি।

গত বছরের চেয়ে এবার প্রণোদনা বেশি লাগবে জানিয়ে তিনি বলেন, গতবছর অনেকেই ঋণ পায়নি। তার মতে, ৫০ শতাংশ কারখানার মালিক এই প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছেন, বাকী ৫০ শতাংশ পাননি। শ্রমিকদের জন্য নতুন করে ১০ হাজার কোটির ঋণ ছাড়াও সরকার আগেরবার যে সুবিধাগুলো দিয়েছে, সেই সুবিধা যাতে সত্যিকারভাবে কাজে লাগাতে পারি সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য এইসব প্যাকেজ থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য দীর্ঘ সময় দিতে হবে। যেমন, শ্রমিকদের জন্য যে ঋণ নিয়েছি, সেটা ১৮ কিস্তিতে শোধ দেওয়ার বিধান রয়েছে। আমরা এটাকে ৬০ কিস্তিতে দিতে চাই। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে ১৮ কিস্তিতে অধিকাংশ কারখানার মালিকের পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলছেন, কারখানা চালু থাকলে নতুন প্রণোদনা নাও লাগতে পারে। তবে আগের প্রণোদনা থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধের সময় বাড়াতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, প্রয়োজন হলে আমরা নতুন প্রণোদনা সরকারের কাছে চেয়ে নেবো। তার আগে গার্মেন্টস খাতকে লকডাউনের আওতার বাইরে রাখতে হবে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে বিভিন্ন খাতের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। পোশাক কারখানাসহ রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের এপ্রিল, মে জুন ও জুলাই- এই চার মাসের বেতন-ভাতা দিতে সরকারের প্রণোদনা তহবিল থেকে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেন শিল্প মালিকরা। এর বাইরে করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ব্যবসায়ীদের নেওয়া ঋণের সুদেও ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।

উল্লেখ করা যেতে পারে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশেও দেখা দেওয়ার পর এর বিস্তার রোধের পদক্ষেপে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে গত বছরের ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রফতানিমুখী শিল্প বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে এটি বাড়তে বাড়তে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে।

শুধু তাই নয়, করোনাভাইরাসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ভর্তুকি সুদে গতবছর প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্যাকেজ হলো ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের জন্য। বড় উদ্যোক্তাদের জন্য প্রথমে এ ঋণের প্যাকেজ ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা দুই দফায় বাড়িয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। এই ঋণের সুদে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে সাড়ে ৪ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এখনও বলা যাচ্ছে না ১৪ এপ্রিল থেকে কেমন লকডাউন হবে। তবে সরকার যদি সব কিছু দীর্ঘ মেয়াদে বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করে, আর সেই পরিকল্পনা যদি এক মাসের বেশি হয়, সেক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের নতুন প্রণোদনা দেওয়া লাগতে পারে। আর যদি সরকার স্বল্পকালীন সব কিছু বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করে, সেক্ষেত্রে কেবলমাত্র ক্ষুদ্র আয়ের মানুষদের জন্য প্রণোদনার দরকার হবে। কারণ, সব কিছু বন্ধ হলে অল্প আয়ের মানুষদের আয় কমে যাবে। তাদের জন্য কম মূল্যে খাবার বিতরণ করতে হবে। বিনামূল্যে খাবার বিতরণ চালু রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের জন্য খুব বেশি কিছু করার প্রয়োজন পড়বে না।

তার মতে, লকডাউনে সব কিছু বন্ধ হলে তবেই নতুন প্রণোদনা লাগবে। আর সবকিছু খোলা রেখে সেনাবাহিনী নামিয়ে মাস্ক পড়া ও স্বাস্থ্যবিধি মানা বাধ্যতামূলক করা সম্ভব হলে এক্ষেত্রে কোনও প্রণোদনা লাগবে না।

গোলাম মোয়াজ্জেম উল্লেখ করেন, সব কিছু খোলা রেখেও সরকার কঠোর হতে পারে। এক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী সামরিক বাহিনী ব্যবহার করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে মনিটরিং জোরদার করে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে, প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া, অথবা জরিমানা আরোপ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনও আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের দরকার পড়বে না। তিনি বলেন, সব খোলা রেখে যদি আইনপ্রয়োগকারী সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে মানুষকে মাস্ক ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা যায়, তাহলে কোনও প্রণোদনা দেওয়ার দরকার হবে না। এতে অর্থনীতিও সচল থাকবে।

প্রসঙ্গত, গতবার প্রণোদনার টাকা লেনদেনের সুবিধার্থে সীমিত আকারে ব্যাংক খোলা ছিল, তবে বেশ কিছুদিন শেয়ার বাজার বন্ধ ছিল। আবার গার্মেন্ট কারখানাও প্রথম কয়েক মাস বন্ধ ছিল। এভাবে করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া গত বছরের উদ্যোগগুলোর প্রশংসা করেছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, তখন ক্ষতি কাটাতে বিশেষ আর্থিক সহায়তা, ঋণ প্রদান, সুদ হার কমিয়ে দেওয়া, আর্থিক প্যাকেজ ও বিশেষ কর্মসূচী ঘোষণার মাধ্যমে প্রণোদন দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপগুলো যেমন, মুদ্রানীতির মাধ্যমে তারল্য সরবরাহ সঠিক রাখা এবং সুদের হার কমিয়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল রাখা। ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দেওয়া, ঋণ পুনঃ তফসিলকরণসহ কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতসহ অন্যান্য খাতে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অন্যতম।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারও সরকার করোনা সংক্রমণ মোকাবিলার পাশাপাশি অর্থনীতি ঠিক রাখতে পারলে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের রোল মডেল। তিনি বলেন, করোনায় বড় বড় দেশগুলো যেখানে অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়েছিল, সেখানে বাংলাদেশ অনেক ভালো করেছে। ২০২০ সালে ভারতে কোনও প্রবৃদ্ধি হয়নি। অথচ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ শতাংশের বেশি। এটা হয়েছে মূলত, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া উদ্যোগগুলোর ফলে।

এদিকে সংক্রমণ কমানোর জন্য পরিপূর্ণভাবে অন্তত দুই সপ্তাহের লকডাউনের সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ঘোষণা দিয়েছেন, গত বছর করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়ের মতো কঠোর লকডাউন আসছে ১৪ এপ্রিল। ওইদিন থেকে এক সপ্তাহের জন্য সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করা হবে। এ সময় জরুরি সেবা ছাড়া সব ধরনের সরকারি অফিস আদালত বন্ধ থাকবে। আবার আওয়া মীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউনের চিন্তার কথা জানান।

অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com

ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১