পাকিস্তানের জান্তারা কেড়ে নিতে চেয়েছিল আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা। লুণ্ঠন করতে চেয়েছিল বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-গর্বের শ্রেষ্ঠ স্থানটি। কিন্তু বাংলার দামাল ছেলেরা তা হতে দেয়নি। বুকের রক্ত দিয়ে তারা প্রতিষ্ঠা করেছে মাতৃভাষার সম্মান। ১৯৫২ সালের এই দিনে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল মাতৃভাষা বাংলার অধিকার।
সেই ভাষাকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করতে প্রণীত হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭। কিন্তু এতকিছুর পরও রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বত্র বাংলার প্রচলন নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি যেসব ক্ষেত্রে কয়েক বছর আগেও বাংলা ব্যবহƒত হতো, সেগুলোতেও এখন প্রচলন ঘটছে ইংরেজির। তেমনটি একটি খাত দেশের ব্যাংক খাত। এ খাতে ক্রমাগত কমছে বাংলা ভাষার ব্যবহার। অভ্যন্তরীণ চিঠিও আদান-প্রদানও হচ্ছে ইংরেজি ভাষায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই উল্টোপথে চলছেন। কারণ হচ্ছে, তাদের সন্তানরা কেউ দেশে থাকছেন না; প্রবাসী হয়ে যাচ্ছেন। সরকারি কর্মচারীদের একটি বড় অংশও প্রবাসী সন্তানদের সূত্রে অবসরের পরে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এজন্য তাদের বাংলা ভাষার প্রতি টান কম।
জানা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পূর্ব-পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে মোট ২২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছিল। যেগুলোর একটির নামও বাংলায় ছিল না।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ নেন বাংলায় নামকরণের। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড এবং ব্যাংক অব ভাওয়ালপুর নিয়ে গঠিত হয় সোনালী ব্যাংক। ইউনিয়ন ব্যাংক ও ইউনাইটেড ব্যাংক মিলে হয় জনতা ব্যাংক। হাবিব ব্যাংক লিমিটেড ও কমার্স ব্যাংক লিমিটেড মিলে নামকরণ করা হয় অগ্রণী ব্যাংকের।
মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড এবং অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংক একীভ‚ত হয়ে গঠিত হয় রূপালী ব্যাংক। ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নামকরণ করা হয় পূবালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনকে করা হয় উত্তরা ব্যাংক।
এছাড়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নামকরণ হয় বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তানকে করা হয় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকের নামকরণ পর্যন্ত ইংরেজি ও বিদেশি ভাষায় হচ্ছে; বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নামকরণ। ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকও তা অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের আমলে ১১টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়, এগুলোর বেশিরভাগেরই নামকরণ হয়েছে ইংরেজিতে।
যদিও ব্যাংক খাতে বাংলা ভাষার ব্যবহারে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে ৫৯টি ব্যাংক বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দুটি ব্যাংক অনুমোদন পেলেও পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করেনি। কার্যরত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বিদেশি ব্যাংক রয়েছে ৯টি। এ সংখ্যা বাদ দিলে ৫০টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ১৬টি ব্যাংকের নাম বাংলা ভাষায়। অবশিষ্ট ৩৪টি দেশীয় ব্যাংকের নাম বিদেশি ভাষায়।
জানা গেছে, সর্ব পর্যায়ে বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধিতে ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ তৎকালীন সরকার সরকারি অফিস-আদালতের দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এটির পুরোপুরি বাস্তবায়নে পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ প্রণয়ন করা হয়। এ আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব ও অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।
কিন্তু দেশের ব্যাংক খাতে বাংলা ভাষার ব্যবহার কমে যাচ্ছে। এমনকি করোনাকালে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন দেয়ালে কাগজ ছাপিয়েছে ‘নো স্টিকার, নো সার্ভিস’। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিষয়ক প্রবীণ সাংবাদিক ও জনতা ব্যাংকের সাবেক পরিচালক আরএম দেবনাথ বলেন, ‘১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন অনুবাদ করেছি বাংলায়। আগে বাংলা ভাষার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হতো, তারপরে ইংরেজি ভাষায়।
বহু কষ্ট হয়েছে অর্থনীতির বিভিন্ন ইংরেজি শব্দের বাংলা সমার্থক শব্দ বের করতে। যেমন ‘পেইড আপ ক্যাপিটাল’ এটিকে কীভাবে বাংলায় আনা যায়। অনেকের সঙ্গে কথা বলে নির্ধারণ করা হলো ‘পরিশোধিত মূলধন’। এভাবে একে একে বাংলা শব্দভাণ্ডার যোগ হলো ব্যাংক খাতে। আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ করেছি ভাষার জন্য; দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার চেতনার অনেক জায়গায়ই আমরা এখন নেই। ব্যাংকগুলোয় ভাষাচর্চা কমে যাচ্ছে।’
এর নেপথ্য কারণ কী এমন প্রশ্নের উত্তরে আরএম দেবনাথ বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা উল্টো পথে রয়েছেন। তারা বাংলা ভাষা চর্চায় মনোযোগী নন। কারণ হচ্ছে, সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মচারীদের প্রায় সবার সন্তানই বিদেশে পড়াশোনা করছে। অবসরের পর তারাও বিদেশে চলে যাবেন। এজন্য দেশ ও ভাষার প্রতি তাদের কোনো দরদ নেই। শিক্ষিত শ্রেণিও ক্রমেই বাংলা ভাষার প্রতি উদাসীন হচ্ছে। একপর্যায়ে দেখা যাবে শুধু গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের মুখেই বাংলা ভাষা টিকে থাকবে।’
বাংলা ভাষার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকেও। অভ্যন্তরীণ নীতিমালা ও ব্যাংকগুলোতে পাঠানো চিঠির সিংহভাগই যাচ্ছে ইংরেজি ভাষায়। প্রতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তা মুদ্রণ করা হয়। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। ইংরেজি সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন বাংলায় প্রকাশিত হয়নি। এটির পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ এখনও চলছে বলে জানা গেছে। এরপরই ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রতিবেদন প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হবে।
ব্যাংকগুলোয় বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মন্ত্রণালয়গুলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিয়মিত যেসব চিঠি দেয়া হয়, তা পুরোটাই বাংলা ভাষায়ই লেখা হয়। এক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের গাড়ির নম্বরগুলো পর্যন্ত বাংলায় করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ চিঠিগুলো বাংলায় দেয়া হচ্ছে। সরকারি নির্দেশনা মানতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে বাংলা ভাষার চর্চাবৃদ্ধির জন্য পরিদর্শন দলগুলোকে তাগাদা দেয়া হবে।’
তবে ব্যাংকে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন ঘটানো জটিল বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্ট অনেকে। এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের পূবালী ব্যাংক থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল হালিম চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যাংকিং সফটওয়্যারগুলো ইংরেজিতে। নতুন সেবাগুলো দিতে হচ্ছে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে; যেগুলোতে ইংরেজি ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু অভ্যন্তরীণ চিঠিগুলো অনেক ব্যাংকই বাংলায় লিখছে। কেউ কেউ লিখছে না। কারণ হচ্ছে, দুটো ভাষার ব্যবহার একসঙ্গে হওয়া। নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া বিদেশি ভাষা ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে ভাষার চর্চা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ব্যাংকাররা যাতে মাতৃভাষার প্রতি আরও যত্নশীল হন সে জন্য উৎসাহমূলক উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।’
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১