অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে ঋণ নেয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে সরকার। যেটুকু নিচ্ছে তাও আবার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয়া উচ্চ সুদের ঋণ দিয়ে পরিশোধ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া কম ঋণের অর্থ। এভাবে গত সাত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিশোধ করেছে ৩৫ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য। সরকারের ঋণের অভ্যন্তরীণ উৎসের অন্যতম খাত হচ্ছে ব্যাংক। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার চাহিদা অনুযায়ী ঋণ নিয়ে থাকে। ঋণের চাহিদা পূরণে সরকার প্রথম দিকেই ঝোঁকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকারের ব্যাংকঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে ব্যবসায়িক স্থবিরতা ও কাক্সিক্ষত রাজস্ব আদায় না হওয়া। দৈনন্দিন বিষয়সহ প্রকল্প বাস্তবায়নে তাই সরকারকে ঋণের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভলো নয়। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে যৎসামান্য খরচ হচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করছে সরকার।
অপরদিকে সরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না। সরকারের প্রণোদনার অর্থও এসএমই খাতের ব্যবসায়ীদের হাতে তেমন একটি যায়নি। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় প্রচুর পরিমাণ তারল্য অলস পড়ে রয়েছে। এজন্য সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়াটা বেশি পছন্দ করছে। এতে ব্যাংকগুলোর একটু সুবিধা হচ্ছে। সরকার দুটি উৎস থেকেই ঋণ নিতে পারে। ভবিষ্যতে যে আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেবে না, তা নয়। বর্তমান অর্থনৈতিক চিত্র ভালো যাচ্ছে না, এটি তারই চিহ্ন।’
বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত বেসরকারি খাতনির্ভর। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রায় ৮০ শতাংশই বেসরকারি খাতনির্ভর। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নি¤œগতিতে রয়েছে, যদিও এ সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না দেশে। বেসরকারি ঋণ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেসরকারি ঋণ প্রবৃৃদ্ধির হার ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা নেমে দাঁড়ায় আট দশমিক ৬১ শতাংশে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) জানুয়ারি-ডিসেম্বরে তা নেমেছে আট দশমিক ৩৭ শতাংশে। অর্থাৎ বেসরকারি বিনিয়োগের সূচকটি নি¤œ গতিতেই নামছে। একই অবস্থা দেশের সার্বিক বিনিয়োগ চিত্রেও। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মোট দেশীয় বিনিয়োগ (সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে) প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ২৬ শতাংশ, এর পরই সেটির অধঃপতন হতে থাকে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯১ শতাংশে।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) জাতীয় বাজেটে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ব্যাংকঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এজন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে চাহিদামাফিক ঋণ নেয়া অব্যাহত রাখে। সর্বশেষ গত ১১ ফেব্রæয়ারি এক হাজার ৯২২ কোটি ৬১ লখ টাকা ঋণ নেয়।
চলতি অর্থবছরের গত ১১ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার নতুন ঋণ নিয়েছে ২৮ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। অপরদিকে গত এক বছরে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৩ হাজার ৯৮৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। গত বছরের শুরুর দিক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পায়।
জানা গেছে, গত বছরের জুন শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় সরকারের ঋণ স্থিতির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩৩ হাজার ৪৬৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা। গত ১১ ফেব্রæয়ারি তা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এ সময়ে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিশোধ করেছে ৩৫ হাজার ২৬১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। গত জুন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল ৪৪ হাজার ৩৫৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। গত ১১ ফেব্রæয়ারি তা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা।
বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ নেয়ার পরিমাণ কমেছে। গত বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল এক লাখ ৭৭ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। গত ১১ ফেব্রæয়ারিতে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার ১২৮ কেটি ১৪ লাখ টাকা। চলতি বছরের এই সময়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ নেয়া কমেছে ছয় হাজার ৬৯৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
যদিও বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মানসুর মনে করেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ হচ্ছে হাইপাওয়ার মানি। এটি পরিশোধ করাই সরকারের অর্থনৈতিক নীতি। ব্যাংকগুলো এখন বিনিয়োগ করতে পারছে না। বিনিয়োগ সুদই হচ্ছে ব্যাংকের আয়ের উৎস। এজন্য ব্যাংকগুলো অলস তারল্য সরকারের বিভিন্ন বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে, এটি নিরাপদ। রাজস্ব আদায় কাক্সিক্ষত হারে না হওয়ায় সরকারকে ঋণ করতে হচ্ছে। তবে ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে উচ্চ সুদে বেশি ঋণ নিচ্ছে সরকার। এটি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।’
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১