২০০৮ সালেরর মন্দার ধাক্কা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছিল বিশ্ব অর্থনীতি। নভেল করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিতে চরম সংকট তৈরি করেছে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে দেশে লকডাউনের জের ধরে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। ২০২০ সালের শুরুতেই চীনের উহান প্রদেশে প্রথম করোনা শনক্ত হয়, পরবর্তীতে এপ্রিলের মধ্যে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার কারণে পুরো ২০২০ সন জুড়ে বিশ্ব ব্যাপী মারাত্নক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দেয়া দেয় যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতেও।
কোভিড-১৯ মহামারির ছোবলে স্থবির অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা পড়েছে ব্যাংক খাতে। বলতে গেলে ২০২০ সাল ব্যাংকারদের জন্য ছিল অস্বস্তি ও অভিশপ্ত বছর। বছরের চার ভাগের তিনভাগ সময় জুড়েই ব্যাংক খাত ছিল করোনায় বিপর্যস্ত। ব্যাংকাররা বলছেন, মহামারির ফলে এই খাতটিতে ইতোমধ্যে যে ক্ষতি হয়েছে গত এপ্রিল মাসেও তা কল্পনা করা যায়নি।করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি দেশীয় অর্থনীতিও থমকে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে পড়েছে।
ছাঁটাই আতঙ্ক ও বেতন হ্রাস
২০২০ সনটি ছিল ব্যাংকারদের জন্য আত্নত্যাগ ও আতঙ্কের বছর। কেরোনা আঘাত করার পর থেকেই বেসরকারী ব্যাংকারদের মধ্যে ছাঁটাই অতঙ্ক তাড়া করে। প্রাণঘাতী ভাইরাস কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য মহামারী শুরু হওয়ার পর দেশের সমস্ত সরকারী বেসরকারী অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করা হয়, শুধু ব্যাংক খোলা থাকে। মহামারী উপেক্ষা করে অকুতভয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা সে সময়েও ডাক্তার, অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও অন্যান্য সম্মুখযোদ্ধাদের ন্যায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে এসেছেন। ফলে হাজার হাজার ব্যাংক কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন এমন সংখ্যাও কম নয়।
ব্যাংকররা যখন মহামারী আক্রান্ত ও মৃত্যু ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বেসরকারী ব্যাংক কর্মীদের মধ্যে নতুন আতঙ্ক দেখা দিল তা হল বেতন হ্রাস ও ছাঁটাই। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো বেসরকারী ব্যাংক কর্মীদের বেতন হ্রাস করার কথা শুনা যায় নাই। এবছর করোনাকালীন সময়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংক বেতন ভাতা হ্রাস করে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় বিভিন্ন বেসরকারী ব্যাংকের প্রায় পাঁচ শতাধিক ব্যাংক কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে।
সুদের হার ৯ শতাংশ কার্যকরে আয় হ্রাস
করোনায় ব্যাংক খাত যখন মারাত্নক অস্থিরতা বিরাজ করছিল ঠিক তখনই অর্থাৎ ১ এপ্রিল থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ ও বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট (এক অঙ্ক) কার্যকর করা হয়। অর্থাৎ ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের ঋণ ও বিনিয়োগের ওপর সর্বোচ্চ সুদ হার হবে ৯ শতাংশ। পরবর্তীতে ক্রেডিট কার্ডের সর্ব্বোচ্চ সুদ হার ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। ব্যাংকের আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে ঋণ/বিনিয়োগের বিপরীতে সুদ বা মুনাফা। সুদ হার হ্রাস পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর আয়ে মারাত্নক ধ্বস নামে। আবার খরচ সমন্বয় কমাতে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ কমানো শুরু করে। ফলে সাধারণ আমানতকারীরা বিপাকে পড়েন।
খেলাপি ঋণের নীতির শিথিলতা
ব্যাংকারদের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা হলো করোনা পরিস্থিতিতে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও সেই ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না মর্মে নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে ঋণের শ্রেণীমান যা ছিল, আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ওই মানেই রাখতে হবে। খেলাপি হলেও নতুন করে ঋণও পেয়েছেন। এতে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠার পরও বাকি কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন তারা। তবে অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, এই সুযোগে কিছু অসাধু গ্রাহকরা ইচ্ছাকৃত কিস্তি পরিশোধ করবে না। আর কিস্তি পরিশোধ না করলেও সেগুলো খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিতও হবে না। এতে অলিখিত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাবে। এই সুযোগ করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কিছু গ্রাহকের জন্য দেয়া হলেও অপব্যবহার করবে অসাধু গ্রাহকরা।
ব্যাংকিং খাতে অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। একটানা আদায় প্রায় বন্ধ থাকবে পুরো ১ বছর। বেশির ভাগ মেয়াদি ঋণের গ্রাহকই এ সুযোগে ঋণ পরিশোধ করছেন না। এতে জানুয়ারির পর থেকে হঠাৎ করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার আশংকাও করা হচ্ছে।
ব্যাংকের মুনাফায় ধস
মহামারি করোনাভাইরাসের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি দেশের অধিকাংশ ব্যাংক। ফলে চলতি বছরের প্রথমার্ধে অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নগদ অর্থ সংকটেও পড়তে হয়েছে কিছু ব্যাংককে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর চলতি বছরের জানুয়াররি-জুন সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে আগের বছরের তুলনায় মুনাফা কমেছে ১৭টির। এছাড়া লোকসানের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে একটি ব্যাংক। ১৭টি ব্যাংকের ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক হওয়া মানে নগদ অর্থ সংকটে পড়া। যে প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ-ফ্লো যত বেশি ঋণাত্মক, ওই প্রতিষ্ঠানের নগদ অর্থের সংকটও তত বেশি।
ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা কমবে, এটা অনেকটা অনুমিতই ছিল। কিন্তু জুন শেষে দেখা যাচ্ছে, ধারণার চেয়েও বড় ধস নেমেছে পরিচালন মুনাফায়। দেশের প্রায় সবক’টি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমেছে, বেশির ভাগ ব্যাংকেরই মুনাফা কমেছে ২৫ শতাংশের বেশি।
প্রথম তিন মাসে ব্যাংকগুলো যে মুনাফা করেছে, তার চার ভাগের এক ভাগ মুনাফাও শেষের তিন মাসে হয়নি। ঋণের কিস্তি আদায় প্রায় বন্ধ। বন্ধ গ্রাহকদের খেলাপি করার পথও। ফলে ব্যবসা সচল, সামর্থ্য আছে—এমন গ্রাহকরাও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করছেন না। আবার ১ এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকের মুনাফার ওপর আঘাত বড় হয়েই দেখা দিয়েছে। বছরের তৃতীয় প্রান্তিকেও মুনাফার পরিস্থির কোন উন্নতি হয়নি।এ পরিস্থিতিতে বছর শেষে ব্যাংকের মুনাফা কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা নিয়েই শঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে।
কাগুজে সুদের পরিমাণ বাড়ছে
বিনিয়োগকৃত অর্থ থেকে প্রাপ্ত সুদই ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস। তবে বিনিয়োগকৃত অর্থ থেকে সেই সুদ আদায় হচ্ছে না ঠিক মতো। সুদ আদায় না হলেও তা স্থগিত সুদ নামে জমা হচ্ছে ব্যাংকের হিসাবে। এভাবেই অনাদায়ী সুদের পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী গত সেপ্টম্বর শেষে এ পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।
অনেকেই ব্যাংক ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে পারছেন না; কিন্তু ব্যাংকগুলোকে প্রতি তিন মাস অন্তর সুদের হিসাব করে থাকে। নিয়মিত তা জানাতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে।
ধার্যকৃত সুদের যে অংশটুকু আদায় হয় না, তা অনাদায়ী সুদ হিসাবে দেখাতে হয়। ঋণ খেলাপিদের কাছেই এ অর্থ পাওনা থাকে। এটি আদায় হলেই আয় খাতে দেখানো হয়; কিন্তু করোনাকালে অনেক ব্যবসায়ী অর্থ পরিশোধ করছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার মাধ্যমে সুযোগটি দেওয়ায় সামর্থ্য থাকার পরও অনেকে দিচ্ছেন না।’ তথ্য অনুযায়ী, অনাদায়ী সুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টম্বর শেষে অনাদায়ী সুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৫৭৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
বিদেশি ব্যাংকের ৩১৪ কোটি, বিশেষায়িত ব্যাংকের ১ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ২২২ কোটি ৪৬ লাখ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। জানা গেছে, অনাদায়ী সুদ হচ্ছে ব্যাংকের সম্ভাব্য সুদ আয়। অনেক ব্যাংকই এটিকে আয় দেখিয়ে আর্থিক প্রতিবেদন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখান। ফলে বাস্তবের চেয়ে কাগুজে সুদের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে যা ভবিষ্যতে ব্যাংক খাতে ভয়াবহ শংকট তৈরি করতে পারে।
প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন
প্রথম পর্যায়ের করোনার ক্ষতি মোকাবেলা তথা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য সরকার ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। প্রণোদনার প্যাকেজ ছিল মোট জিডিপির ৩.৭ শতাংশ। পরবর্তীতে আবার কিছু বাড়ানো হয়। প্রথমে ৫০ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা দেয়া হয় রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানার জন্য। উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতনভাতা দেওয়ার জন্য। এই টাকার সিংহভাগ ঋণ হিসেবে দিচ্ছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ব্যাংকারদের মতে, যদি সরকারের এই প্রণোদনা মেটাতে গিয়ে ব্যাংকের ঋণখেলাপি হয়ে যায় তাহলে তার দায় ব্যাংক কিভাবে নেবে।
প্রভিশন সংরক্ষণে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যাংকাররা
বর্তমানে ঋণ নীতিমালার শিথিলতার কারণে ঋণ বা কিস্তি পরিশোধ না করলেও গ্রাহককে ঋণখেলাপি করা যাচ্ছে না, এতে ঋণ আদায় না হলেও খেলাপি ঋণ না বাড়ায় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে না। এতে ব্যাংকগুলো কৃত্রিম আয় বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আর এ কৃত্রিম আয়ের ওপর ভিত্তি করেই ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সরকারের করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে হবে। সরকারের কর পরিশোধ করার পর যে অংশ বাকি থাকবে তা থেকে শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে মুনাফা বণ্টন করতে হবে। এতে ব্যাংকের ভিত্তি আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। এমনকি অনেক ব্যাংকের মূলধনেও আঘাত লাগতে পারে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপন জারি করে ব্যাংকগুলোর মুনাফায় লাগাম টেনে দিয়েছে।
চলতি বছরের ব্যাংকের হিসাব চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সব অশ্রণেীকৃত ঋণ বা বিনিয়োগের বিপরীতে অতিরিক্ত এক শতাংশ জেনারেল প্রভিশন সংরক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা পরিপালন করতে গিয়ে বেশির ভাগ ব্যাংকই এখন হিমশিম খাচ্ছে। এমনিতেই ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয়ায় এবং এক বছর ঋণশ্রেণীকরণের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়ায় ব্যাংকের আয় কমে গেছে। এর ওপর বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকের নিট আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা করা হচ্ছে। ৩১ ডিসেম্বরের ঋণ স্থিতির বিপরীতেই বাড়তি সঞ্চিতি সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের দেওয়া ঋণের পরিমাণ গত সেপ্টেস্বর পর্যন্ত ১১ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে খেলাপি হয়নি—এমন ঋণই ৯ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। গত বছর এই ১০ ব্যাংক কর–পরবর্তী নিট মুনাফা করেছিল ২ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। আর এ বছর তাদের সঞ্চিতিই রাখতে হবে ৩ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ)সূত্রে জানা যায়,৩০টি তালিকাভুক্ত ব্যাংক ২০১৯ সালে কর–পরবর্তী নিট মুনাফা করেছিল ৭ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত তা দাঁড়াবে ৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকায়। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করতে গেলে ব্যাংকগুলোকে ৯ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত সঞ্চিতি রাখতে হবে।ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হলে অনেক ব্যাংক লোকসানেও পড়তে পারে।
অলিখিত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি
দেশের ব্যাংকগুলোর প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ কত তার বাস্তব পরিসংখ্যান জানা যাচ্ছেনা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে ঋণের শ্রেণীমান যা ছিল, আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ওই মানেই রাখতে হবে।এতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়লেও কাগজে-কলমে তা কম দেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ ছিল ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিয়মিত ঋণ রয়েছে ৯ লাখ ২৪ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। আর সাড়ে ৯৪ হাজার কোটি টাকা রয়েছে খেলাপি ঋণ, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বাকি সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ বা অনিয়মিত ঋণ। এসব ঋণের কিস্তি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ছয় মাস পার হলেই তা খেলাপি ঋণের ঘরে চলে যাবে।
তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বরাতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বলছে, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা; এর সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ (৫৪,৪৬৩ কোটি টাকা) যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা।
বাস্তবতা হচ্ছে পুরো এক বছরের অনাদায়ী কিস্তি যোগ করলে ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ জানা যাবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ঋণ আদায় হওয়ার আপাততঃ কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। ফলে শেষ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ কী পরিমাণ দাঁড়ায় এবং ব্যাংকাররা বিশাল অংকের এ খেলাপি ঋণ কিভাবে আদায় করবেন সেটাই এখন দুশ্চিন্তার বিষয়।
ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা স্থগিত
৯১তম ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা গত জুনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। পরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে তা স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে ২৭ নভেম্বর প্রথম দিনের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও ৪ ও ১১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ব্যাংক কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে ব্যাংকিং ডিপ্লোমার জন্য নির্দিষ্ট নম্বর রাখা বাধ্যতামূলক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে কোনও কর্মকর্তা ডিপ্লোমা কোর্স করলে তার পদোন্নতিতে নির্দিষ্ট নম্বর যোগ হবে। ডিসেম্বর/জানুয়ারীতে অনেক ব্যাংকে পদোন্নতি শুরু হতে পারে। ফলে যে সব ব্যাংকারদের ডিপ্লোমা সনদ নাই তারা নির্দ্দিষ্ট নম্বর কম পাওায় পদোন্নতি বঞ্চিত হতে পারেন।
পদোন্নতি স্থবিরতা
প্রায় প্রতিবছর ডিসেম্বর/জানুয়ারী মাসে বিভিন্ন ব্যাংকে বিশেষ করে বেসরকারী পদোন্নতির মৌসুম শুরু হয়। কিন্তু এ বছর অল্প দু’একটি ব্যাংকের কথা শুনা গেলেও অধিকাংশ ব্যাংকই কর্মী পদোন্নীতিতে নীরব রয়েছে বলে জানা যায়।
ইনসেনটিভ বোনাস
অনেক বেসরকারী ব্যাংক প্রতি বছর শেষে মুনাফা থেকে কর্মীদেরকে প্রণোদনা হিসাবে ইনসেনটিভ বোনাস দিয়ে থাকে। এবছর ব্যাংক কর্মীদের ভাগ্যে কি আছে তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলে দিবে।
সব মিলিয়ে ২০২০ সনটি দেশের অন্যান্য খাতের সাথে ব্যাংকিং খাত অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটল। ব্যবসা বাণিজ্য মন্দা, বেতন ভাতা হ্রাস, কর্মী ছাঁটাই, চাকুরীতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি সহ নানামুখী চাপের কারণে অনেক ব্যাংকাররা ২০২০ সনকে অভিশপ্ত বছর হিসাবেও আখ্যায়িত করেছেন।
২০২০ সনের সব হিসাব নিকাশ শেষ, আগামীকাল ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংকগুলোর চুড়ান্ত আর্থিক ফলাফল জানা যাবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, করোনার কার্যকরী প্রতিষেধক টিকা দেয়ার মাধ্যমে করোনা নির্মূল হলেই আবার অর্থনৈতিক অবস্থা তথা ব্যাংকিং ব্যাবসা চাঙ্গাভাব ফিরে আসতে পারে। আশার কথা হলো বছরে শেষ দিকে দেশের অর্থনীতি তথা ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়ানোর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। করোনার কালো মেঘ কেটে দেশের অর্থনীতিতে সূর্যের হাসি ফুটে উঠুক এটাই সবার প্রত্যাশাই ।
লেখকঃ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ইমেইলঃ ma_masum@yahoo.com