Alternate শব্দটি Adjective এবং Alternative হচ্ছে Noun। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় শব্দ দুটোই ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বাংলা শাব্দিক অর্থ একই ধরনের হওয়াতে সংশ্লিষ্টজনের পছন্দ অনুযায়ী ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যাংকিং এর প্রাগৈতিহাসিক কাল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ডিজিটাল ব্যাংকিং এর জন্মসূত্র হলো ATM তথা Automated Teller Machine স্থাপনের মধ্য দিয়ে। যা গোড়া থেকেই সংযুক্ত ও নামকরণ হয় The Alternative Delivery Channel এবং এর একনিষ্ঠ তত্ত্বাবধানে। এটি ব্যাংকিং ব্যবসায় সার্ভিস ব্যয় কমিয়ে সহজ ও প্রযুক্তি নির্ভর বিকল্প ব্যাংকিং সলিউশন ও নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরী করেছে। এ পরিবর্তন শুধু মানুষের চাহিদাই বাড়ায়নি বদলে দিয়েছে মানুষের জীবনের আকৃতিও। এর সৌজন্যে দিনের পর দিন শুধু গ্রাহক প্রিয়তার শীর্ষেই নয়, এটি অন্যতম ব্যবসায়িক উপাদান হিসাবে সূচিত এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অপার শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে প্রজ্বলিত।
ফিনটেক ইতিহাসের দ্বিতীয় স্তর (১৯৬৭-২০০৮) এর শুরুর দিকে ব্যাংকিং সেবায় উন্নত প্রযুক্তি যুক্ত হয়ে এক বিরল দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা সার্বক্ষণিক নগদ অর্থ উঠানো সুবিধা, শাখা থেকে নগদ ক্যাশ উত্তোলন হ্রাস, নির্ভুল সেবা ও টেলারদের নিরলস কষ্ট লাগবের নিমিত্তে Mr. De La Rue ১৯৬৭ সালের ২৭ জুন প্রথমে ইলেকট্রনিক ATM ডেভেলপমেন্ট করেন। আর সেটা স্থাপিত হয় নর্থ লন্ডনের বার্কলেস ব্যাংকের একটি শাখার সন্নিকটে। যদিও আমেরিকান লুথার সিমজিয়ান মেকানিক্যাল ক্যাশ ডিসপেনসার তৈরী করেছিলেন ১৯৩৯ সালে। সেটি City Bank কর্তৃক নিউইয়র্ক সিটিতে ইনস্টল করে ব্যাংকিং ইতিহাসে অনন্য হয়ে আছে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ১৯৯৩ সালে প্রথম নগদ বিতরণকারী ATM বুথ স্থাপন করেন ঢাকার বনানীতে যা ইনস্টল ও দেখভাল করেছিল লিডস করপোরেশন লিঃ। এটি NCR দ্বারা নির্মিত তৃতীয় প্রজন্মের ATM ছিল। তৎকালীন সময়ে বুথ ব্যবহারের চেয়ে বিভিন্ন পেশা ও শ্রেনীর দর্শনার্থীর সংখ্যাই ছিল বেশি। গ্রাহক সমাগম কম থাকায় ১৯৯৪ সালে ঐ ATM বুথটি তৎকালীন ঢাকা শেরাটন হোটেলে স্থানান্তরিত হয় এবং বিদেশী অতিথিরা এই হোটেলে থাকাকালীন সময়ে বুথটি ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে স্থানীয় ব্যাংকগুলো ATM বসাতে শুরু করে যা সারাদেশে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। সময়ের পরিবর্তনে যুক্ত হয় Cash Deposit Machine (CDM) এর পরই আরো উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় স্থাপিত হচ্ছে Cash Recycle Machine (CRM/ATM), এর মাধ্যমে কেবল নগদ উত্তোলন নয় জমাও দেয়া সম্ভব। বর্তমানে এই নগদ বিতরণ ও জমাদানের বুথ সকল পেশা ও শ্রেণি গ্রাহকদের জন্য অপরিহার্য হয়ে ব্যাংকিং শিল্পের ভৌত চেহারা বদলে দিয়েছে।
উন্নত দেশে ইন্টারনেট চালু হয় ১৯৬৯ সালে এবং মি: ভিনটন জি কার্ফ এটির জনক হিসেবে সমগ্র পরিচিত। বিশ্ব পরিমন্ডল অতিক্রম করে বাংলাদেশে ইন্টারনেট চালু হয় ১৯৯৬ সালে। বিজ্ঞানের এমন বিস্ময়কর আবিস্কারের সুফলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকেও আমুল পরিবর্তন করতে সাহায্য করেছে।
ADC বলতে সাধারণত: এটিএম বুথ স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ, ক্যাশ লোড ও আনলোডের ( Replenish ) দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকাণ্ড বিভাগকেই বুঝাতো। সময়ের প্রয়োজনে ব্যাংক এশিয়ার এডিসি সহ বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন উদ্ভাবনী বিকল্প সার্ভিস চালু করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যাংকিং, এটিএম কার্ড, স্মার্ট এ্যাপ সার্ভিস, ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং, ই-ওয়ালেট, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, এমএফএস, ইউটিলিটি বিল পেমেন্ট, জীবন বীমা, মেটলাইফ ইন্সুরেন্স, ঋণের কিস্তি, টিউশন ফি সংগ্রহ, ঘরে বসেই হিসাব খোলা, ই-জিপি, এ-চালান এবং টেলি ব্যাংকিং সুবিধা সহ নানান ধরনের বিকল্প চ্যানেল সংযুক্ত হয়ে সার্ভিস সহজীকরণ ও বাড়িতে বসেই ব্যাকিং সম্পন্ন করার পদ্ধতি প্রশস্ত করেছে।
দীর্ঘদিনের পরিক্রমায় কভিড-১৯ এর মধ্যে বিকল্পধারার ব্যাংকিংয়ের পূর্ণ সুবিধা গ্রহণপূর্বক অতিমারির লকডাউনের মধ্যেও ব্যাংকিং চালু রেখে জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন ও নতুন আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর যে ধারায় ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে আসছিল তা থেকে পরিবর্তিত হয়ে নতুনত্ব প্লাটফর্মে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং পরিমন্ডলের দৃষ্টিকোণ থেকে ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখনো পিছিয়ে রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সরকার যথেষ্ঠ আন্তরিক। তারই ধারাবাহিকতায় ১২ ডিসেম্বর -২০২১ ইং তারিখে পঞ্চম জাতীয় ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস পালন করেছে।
বর্তমান সরকার "দিন বদলের সনদ" এর অংশ হিসেবে অনেক রাষ্ট্রীয় অটোমেশন ও ডিজিটাল ব্যাংকিং ট্রানজেকশন হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো উন্নত ডিজিটালাইজেশন সাফল্যের দোড়গোড়ায় অপেক্ষা করছে। তবে ডিজিটাল দেশ গঠনে সরকার আন্তরিক হলেও বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারনে আজও অতিশয় অপরিহার্য একটি পূর্ণাঙ্গ "ডিজিটাল ব্যাংক" গঠন করা সম্ভব হয়নি। আধুনিক প্রজন্মের আর্থিক চাহিদা পূরণের নিমিত্তে ও সত্যিকার ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে ব্যাংক এশিয়া গত বছর থেকেই ‘ডিজিটাল ব্যাংক’ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ও সেই লক্ষ্যে নিরলসভাবে সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
চলমান বিশ্ব হলো তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বয়ে গঠিত বিশ্ব। সাম্প্রতিক স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী অতিক্রম করেছে। পরিবর্তনশীল বর্তমান দুনিয়ায় যে জাতি তথ্যপ্রযুক্তিতে যতই দক্ষ সে জাতি ততই উন্নত। আর দেশের শিল্প কারখানা, আমদানি, রপ্তানি, ব্যবসা, বাণিজ্য ও সামগ্রিক আর্থিক কর্মকান্ড প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ব্যাংকিং শিল্পের কাধে ভরদিয়ে। আর গ্রাহকশ্রেনীর একটি অংশ শাখা ব্যাংকিং থেকে বেরিয়ে অন্য চ্যানেলে চলে যাচ্ছেন। তাই আগামীর ব্যাংকিং কোন দিকে প্রবাহিত তা যথেষ্ঠ অনুমেয়। সুতরাং ব্যাংকিং ব্যবস্থার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বহিঃবিশ্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আধুনিক, বিকল্প ব্যাংকিংয়ের ধারা অব্যাহত ও জ্ঞানভিত্তিক ব্যাংকিং সমাজ গড়তে এই খাতের পৃষ্ঠপোষক, সংশ্লিষ্টদের সার্বিক সহযোগিতা, ইনভেস্টমেন্ট বৃদ্ধি ও ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন একান্তভাবে জরুরি।
লেখকঃ ব্যাংক কর্মকর্তা
অলটারনেটিভ ডেলিভারী চ্যানেল, ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড।