ঢাকা বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ব্যাংক খাত কতটুকু এগোল
  • এম. এ. মাসুম
  • ২০২১-১২-১৭ ০৬:৪৬:৫০

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ১৯৭১ সালের পরবর্তী বাংলাদেশ ছিল একটি বিধ্বস্ত অর্থনীতি। বেশির ভাগ সড়ক, সেতু ও অবকাঠামো বিনষ্ট করা হয়েছিল। আবুল কাশেম লিখেছেন, ব্যাংকে টাকা নেই, ট্রেজারি খালি, টাকা-পয়সা সোনাদানা কিছুই নেই। সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে পাকিস্তানের লুটেরা বাহিনী। আত্মসমর্পণের আগে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট; পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত, দোকানপাট। সমুদ্রবন্দর, নৌবন্দর, রেললাইন সবই ধ্বংস।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে তত্কালীন সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হয়ে ওঠে অর্থনীতিকে দাঁড় করানো এবং এর পুনর্গঠন। সেলক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অর্থনৈতিক পুনর্বাসন, পুনর্গঠন ও সংস্কারের অংশ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পুনর্গঠনো প্রতি মনোনিবেশ করেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পুনর্গঠন ছিল দুরূহ কাজ। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নীতিনির্ধারণী কাজ, মুদ্রাবিষয়ক ব্যাংকিং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতো পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। স্বাধীন বাংলাদেশে তত্কালীন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঢাকা শাখাই ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ নামে স্বাধীন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে আবির্ভূত হয়। ব্যাংকব্যবস্থা পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক গতি চালু করার জন্যই ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি আদেশ-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক গঠন করা হয়। এ আদেশ কার্যকর করা হয় ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ থেকে।

স্বাধীনতার পূর্বে মোট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছিল ২২টি। এর মধ্যে ৩টি বিদেশি ব্যাংক, ৫টি ভারতীয় ব্যাংক, ১০টি অবাঙালি পাকিস্তানি মালিকানাধীন, ২টি বাঙালি মালিকানাধীন ব্যাংক এবং ২টি সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী তত্কালীন সরকার ‘বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয়করণ অধ্যাদেশ, ১৯৭২’-এর আওতায় ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠন শুরু করে। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের দুটি শাখা অফিস ও ১৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের উপস্থিতি ছিল। স্বাধীনতাপূর্ব ব্যাংকিং কার্যক্রম এ দেশে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ এবং সম্পূর্ণভাবে শহর এলাকায় কেন্দ্রীভূত ছিল। যার মধ্যে তিনটি বিদেশী এবং দুটি বাংলাদেশীদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো। স্বাধীনতাপূর্ব ১২টি ব্যাংক একত্রিত করে ছয়টি সরকারি ব্যাংকে রূপান্তরের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ব্যাংকিং খাত যাত্রা শুরু করে। সোনালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং ব্যাংক অব ভাওয়ালপুর লিমিটেডকে একত্রিত করে; অগ্রণী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড, হাবিব ব্যাংক লিমিটেড ও কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের সমন্বয়ে; জনতা ব্যাংকের যাত্রা শুরু ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেডের সংযুক্তির মধ্য দিয়ে; রূপালী ব্যাংক স্থাপিত হয় মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডকে একত্রিত করে; পূবালী ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে অস্ট্রেশিয়া ব্যাংক ও ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংককে একসঙ্গে করে এবং উত্তরা ব্যাংকের যাত্রা শুরু ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের পরিবর্তিত নামে।

আশির দশকের প্রারম্ভে ব্যাংকিং খাতকে আরো গতিশীল এবং সেবার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে বেসরকারি ব্যাংক চালু করার অনুমোদন দেয়া হয়। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম বেসরকারী ব্যাংক হিসেবে এবি ব্যাংক লিমিটেড (তৎকালীন আরব-বাংলাদেশ ব্যাংক)১৯৮১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করে এবং ১৯৮২ সালের ১২ই এপ্রিল ব্যাংকটি কার্যক্রম শুরু করে।তারপর ১৯৮৩ সনে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ, সিটি ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংক, ন্যাশনাল কমার্স এন্ড ক্রেডিট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতে নতুন মাত্রা যোগ হয় এবং ব্যবসা বাণিজ্যের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে।সেসাথে সরকারী ব্যাংকগুলো বেসরকারী ব্যাংকের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে শুরু করে। এরপর ১৯৯৩ সালে ৫টি, ১৯৯৫ হতে ১৯৯৮ সালের মধ্যে ৮টি এবং ২০১৩ হতে ২০১৬ পর্যন্ত সর্ব্বোচ্চ ১৩টি বেসরকারী ব্যাংককে অনুমোদন দেয়া হয়।

বর্তামানে দেশী বিদেশী মোট ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬১টি এর মধ্যে রাষ্ট্রায়াত্ব ৬টি, বিশেষায়িত ৩টি,বেসরকারী ৪৩টি, বৈদেশিক ব্যাংক ৯টি এছাড়া নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৩৪টি। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

দেশের ব্যাংকগুলোর বর্তমানে মোট শাখার সংখ্যা প্রায় ১১,০০০, আমানত প্রায় ১৫ লক্ষ কোটি টাকা,ঋণ বিতরণ প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা। দেশের বৈদেশিক মুদার রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার যা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের অবস্থান তৃতীয়। ১৯৭৫ সালের পর ব্যাংকের সহায়তার ফলেই রফতানি আয় ১৩৩ গুণ বেড়েছে। ১৯৮২ সালে যে ঋণ ছিল ৬৭৮ কোটি টাকা তা ২০২০ সালে এসে দাঁড়ায় ২৪.৫ হাজার কোটি টাকায়।

বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে দেশি-বিদেশি উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশে দিন দিন ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিকাশ ঘটছে এবং বর্তমানে ইসলামি ধারার ব্যাংকের সংখ্যা ১০টি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ ২০২১ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামি ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা যা মোট আমানতের ২৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এসময়ে ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ২২ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা যা মোট বিতরণের ২৫.৩৩ শতাংশ। অন্যদিকে বর্তমানে প্রবাসী আয়ের ৩৩ শতাংশই আসে ইসলামি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে।

তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে ব্যাংক এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ডিজিটাল ফাইন্যান্সের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে গত দুই দশকে। দেশের শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্জলের অধিকাংশ জনগণকে আর্থিক সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।

ব্যাংকিং খাতের অনেক সাফল্য থাকলেও পাহাড়সহ খেলাপী ঋণ, প্রভাবশালীদের অনৈতিক হস্তক্ষেপ, ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতি, অনেকাংশে সুশাসনের অভাব ইত্যাদি ব্যাংক খাতে কালিমার দাগ ফেলেছে।

সকল বাধা বিপত্তি ও চ্যালেঞ্চ মোকাবেলা করে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আরো উন্নততর পর্যায়ে পৌঁছাবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখকঃ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

ইমেইলঃ ma_masum@yahoo.com

বাণিজ্যিক ব্যাংকের নামের শেষে ‘পিএলসি’, সুবিধা-অসুবিধা
পদোন্নতি হলোনা, কি করবেন
রাশিয়ার উপর নিষেধজ্ঞায় বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে প্রভাব