সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসার ক্ষেত্রে আরেকটি হতাশাজনক বছর পার করল বাংলাদেশ। ২০২০ সালে বাংলাদেশে এফডিআই এসেছে আগের বছরের চেয়ে ১১ শতাংশ কম। ২০১৯ সালেও বিদেশি বিনিয়োগ ২০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। শুধু বাংলাদেশ নয়, করোনার কারণে গত বছর বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই বিনিয়োগ সংকোচন হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়, নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ ৮৭ শতাংশ কমেছে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড সোমবার 'বিশ্ব বিনিয়োগ রিপোর্ট-২১' প্রকাশ করেছে। রিপোর্টে বাংলাদেশসহ প্রত্যেক দেশের বিনিয়োগ আসার এবং বহির্বিশ্বে বিনিয়োগ করার ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান রয়েছে। আঙ্কটাড বলেছে, করোনার কারণে চালু থাকা বিনিয়োগ প্রকল্পের গতি ধীর হয়েছে এবং মন্দার আশঙ্কায় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নতুন উদ্যোগ একেবারেই কমে গেছে।
আঙ্কটাডের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত বছর বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ২৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এফডিআইর এই পরিমাণ দেশের জিডিপির ১ শতাংশেরও কম। এর আগের বছর ২০১৯ সালে এফডিআই এসেছিল ২৮৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যার পরিমাণ বর্তমান হার অনুযায়ী ২৪ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৩৬১ কোটি ডলারের সর্বাধিক বিনিয়োগ এসেছিল। তৈরি পোশাক খাতে বড় অঙ্কের রপ্তানি আদেশ বাতিল হওয়াকে গত বছর এফডিআই কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ আসার পরিমাণ যে হারে কমেছে, তার চেয়ে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ অনেক বেশি হারে কমেছে। ২০২০ সালে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ (গ্রিনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট) ঘোষণার আর্থিক পরিমাণ মাত্র ৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার। আগের বছর যা ছিল ৫৭৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত বছর ১৫টি নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে। এর আগের বছরে যা ছিল ১৮টি। ২০১৮ সালে ছিল ২৮টি। আঙ্কটাডের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০২০ সাল শেষে মোট বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি ১ হাজার ৯৩৯ কোটি ডলার, যা এর আগের বছর শেষে ছিল ১ হাজার ৭৭৮ কোটি ডলার।
আঙ্কটাড বলেছে, নতুন প্রকল্পের ঘোষণা ভবিষ্যতে বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হওয়ার নির্দেশক। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে অবস্থার অবনতি হওয়ায় বিনিয়োগ পরিস্থিতি কভিডের আগের অবস্থায় ফেরত যেতে দেরি হতে পারে। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশের পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগের আগ্রহ কম থাকা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ কমার কারণ। ২০২০ সালে এ খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোট ৩০০ কোটি ডলারের রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়।
আঙ্কটাডের রিপোর্ট অনুযায়ী সারাবিশ্বের দেশগুলো ২০২০ সালে এফডিআই পেয়েছে ১ লাখ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৮৫ লাখ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে বিশ্বে এফডিআই ছিল দেড় লাখ কোটি ডলার। গত বছর দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু ভারত ছাড়া সব দেশের এফডিআই কমেছে। অন্যদিকে চীন ও হংকংয়ের কারণে সার্বিকভাবে এশিয়াতে বিনিয়োগ আগের বছরের চেয়ে ৪ শতাংশ বেড়েছে।
এফডিআই কমার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে সারাবিশ্বে কমেছে। বাংলাদেশের কমে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার মতে, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ নিম্ন মাত্রার। ২০১৮ সাল বাদে গত কয়েক বছরে তা ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ছিল। জাপান টোব্যাকোর বড় বিনিয়োগের কারণে ২০১৬ সালে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এসেছিল। দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। বড় বড় অবকাঠামো হচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যে এফডিআই পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি হবে। নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ অনেক কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনার কারণে শারীরিকভাবে আসতে পারেননি। নতুন প্রকল্প নেওয়ার কারণে শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে অনেক কিছু যাচাই-বাছাইয়ের দরকার হয়।
বিশেষজ্ঞ মত : বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, করোনা সংক্রমণই বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মূল কারণ। তবে করোনা না থাকলে বাংলাদেশে খুব বেশি বাড়ত, তাও বলা যাবে না। কারণ বিনিয়োগের পরিবেশ সহজ করার ক্ষেত্রে তেমন উন্নতি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব দেশ বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য বাড়াতে পেরেছে, সংস্কারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাদের পর্যায়ে যেতে পারেনি। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনও অনেক জটিলতা আছে। নানা ধাপ পেরোতে হয়। সময় লাগে অনেক বেশি। ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রকত অর্থে 'ওয়ান স্টপ' হয়নি।
নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশি পিছিয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে জাহিদ হোসেন বলেন, নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের বেশি আকৃষ্ট করতে হলে অবকাঠামো ও অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি থাকতে হয় যে, প্রাথমিক পর্যায়েই তারা যেন বুঝতে পারে সবকিছু প্রস্তুত আছে। যেমন- এখানে এসে দক্ষ কর্মী পাবে কিনা, না পেলে বিদেশ থেকে আনতে পারবে কিনা এবং আনতে গেলে নীতির জটিলতা আছে কিনা- এসব বিষয়ে বিনিয়োগকারীর সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। তার মতে, বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে বলা হচ্ছে, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। এর মধ্যে অগ্রাধিকার ঠিক করে অন্তত ১০টি অঞ্চলকে পুরোপুরিভাবে তৈরি করলে নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফিকির সভাপতি ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী বলেন, করোনার সময় সবাই সতর্ক, যা এফডিআই কমার বড় কারণ। বিনিয়োগ পরিবেশের যথেষ্ট উন্নতি করা গেলে হয়তো আরেকটু বেশি বিনিয়োগ আসত। এবারের বাজেটে করপোরেট কর কমানোসহ কিছু রাজস্ব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সহায়ক। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করতে হবে।
সম্ভাবনা ওষুধ শিল্পে : আঙ্কটাডের রিপোর্টে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের সক্ষমতা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। রিপোর্টে বাংলাদেশের বেক্সিমকো ও ইনসেপ্টা ফার্মার নাম উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, মেধাস্বত্ব সংক্রান্ত বিধিবিধান পালনে এলডিসি হিসেবে ছাড় এবং সরকারের সহযোগিতায় বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প অনেক এগিয়ে গেছে। বেক্সিমকো ফার্মা ২০১৫ সালে হেপাটাইটিস সি-র জেনেরিক ভার্সন বাজারে আনে। ইনসেপ্টা ফার্মা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদিত কভিড ভ্যাকসিন বাংলাদেশে তৈরির ব্যাপারে সক্ষম। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের সক্ষমতা রয়েছে। আগামীতে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য এ খাত আকর্ষণীয় হতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতি : দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কারণে সার্বিকভাবে এফডিআই বেড়েছে ২০ শতাংশ। ভারতে ২০২০ সালে এসেছে ৬ হাজার ৪০৬ কোটি ডলারের বিনিয়োগ, যা আগের বছরের চেয়ে ২৭ শতাংশ বেশি। পরিমাণের বিচারে ভারতের পর দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। পাকিস্তানে বিনিয়োগ এসেছে ২১০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৬ শতাংশ কম। শ্রীলঙ্কায় এসেছে ৪৩ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৩ শতাংশ কম। নেপাল ও মালদ্বীপেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ ঘোষণা কমেছে। তবে ভারতে খুব বেশি কমেনি। বাকি দেশগুলোর সবারই এক্ষেত্রে বড় পতন হয়েছে।