খেলাপি ঋণের বেশির ভাগই মন্দ বা আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে। মার্চ শেষে ৯৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। হিসাব মতে খেলাপি ঋণের ৮৮ শতাংশের ওপরে রয়েছে আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণ। একে তো করোনার প্রাদুর্ভাব, ব্যবসা মন্দা, বিনিয়োগ অন্য দিকে মন্দ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকিং খাতে অস্বাভাবিক হারে কমে যাচ্ছে আয়। শুধু মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকিং খাতে সুদ আয় স্থগিত করা হয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে শুধু মুনাফা কমে যাচ্ছে না, সাথে শেয়ারহোল্ডাররাও বছর শেষে প্রকৃত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি টাকা আটকে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
এ দিকে মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংক শুধু আয় থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে না, যে পরিমাণ মুনাফা করেছিল তা দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণও করতে পারছে না অনেক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, জুন শেষে এমন ১০টি ব্যাংক তাদের আয় দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। উপরন্তু তাদের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা নানা প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু পরিশোধ করছেন না। একপর্যায়ে ওই ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এসব খেলাপি ঋণ নবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালাও শিথিল করা হচ্ছে। কখনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়ে, কখনো ১ বা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়ন করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। আর করোনায় প্রায় দেড় বছর ধরে ঋণ আদায়ে শিথিলতা চলছে। এ সময়ে ঋণ পরিশোধ না করলেও ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত মার্চ শেষে ৯৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে বেশির ভাগ অর্থাৎ প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকাই মন্দ বা কুঋণে পরিণত হয়েছে, যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৮ শতাংশের ওপরে। মন্দ ঋণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আদায় হয় না। একপর্যায়ে এ ঋণ অবলোপন বা খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে আলাদা করে রাখা হয়।
ব্যাংকভেদে মন্দ ঋণের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ ৪৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ অর্থাৎ ৪০ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। আর বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মার্চ শেষে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৪৪ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৬ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকাই মন্দ ঋণ, যা শতকরা হিসাবে ৮৩ ভাগ। তিন বিশেষায়িত ব্যাংকের ৮৩ শতাংশ মন্দ ঋণ। আর বিদেশী ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ রয়েছে ৮৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, মন্দ ঋণের বিপরীতে ধার্যকৃত মুনাফা বা সুদ ব্যাংকগুলো আয় হিসেবে দেখাতে পারে না। এসব সুদ বা মুনাফা ব্যাংকের আয় খাত থেকে আলাদা করে রাখা হয়। অন্য দিকে মন্দ ঋণ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ হিসাবে ধরা হয়। এ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। প্রভিশন হলো আমানতকারীদের আমানত সুক্ষা করতে সংরক্ষিত অর্থ। একে নিরাপত্তা সঞ্চিতিও বলা হয়। প্রভিশন ঘাটতি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলোর জরিমানা বা তিরস্কার গুনতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মার্চ শেষে মন্দ ঋণের বিপরীতে সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে ১৮ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সুদ আয় স্থগিত রাখা হয়েছে ১৭ হাজার ৬২৩ কোটি টাকার। বিদেশী ব্যাংকগুলোর ৩১৪ কোটি টাকা এবং তিন বিশেষায়িত ব্যাংকের এক হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা। সব মিলে মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের বিপরীতে সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার।
পাশাপাশি খেলাপি ঋণের বিপরীতে টাকা আটকে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। কারণ ঋণ আদায় হলে ওই ঋণ আবার ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু ঋণ আদায় না হলে ব্যাংকগুলো ওই অর্থ আর পুনঃবিনিয়োগ করতে পারে না। এভাবে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে যায়। আবার এ মন্দ ঋণের বিপরীতে সুদ স্থগিত করায় ব্যাংকের আয়ও কমে যাচ্ছে।