নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে ব্যাংক। ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হলেও আমানতের সুদহার নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বেশি সুদে আমানত নেয়ায় নির্ধারিত সুদে ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। অনেক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশিত প্রণোদনা প্যাকেজ ও সরকারি বিল বন্ডে বিনিয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
ব্যাংকার জানিয়েছেন, গত এক বছর যাবৎ ব্যাংককার্যক্রম একমুখী হয়ে পড়েছে। শুধু ঋণই বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে ঋণ আদায় করা যায়নি। এতে ব্যাংকের অন্তঃমুখী টাকার প্রবাহ কমে গেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে। এর প্রভাবেই নতুন বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে কয়েকজন শিল্পোদ্যোক্তা জানিয়েছেন, জনসংখ্যা বাড়ছে। প্রয়োজন হচ্ছে বাড়তি কর্মসংস্থানের। আর এ বাড়তি কর্মসংস্থানের সংস্থান করতে প্রয়োজন বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ। কিন্তু নতুন বিনিয়োগ কার্যত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই নতুন নতুন প্রকল্প তৈরি করছে। বিদ্যমান শিল্পকারখানা সময়ের প্রয়োজনে বর্ধিত করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিন্তু অর্থের জোগানদাতা ব্যাংকগুলো নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বরং তারা পারলে চলতি মূলধনেরও জোগান বন্ধ করে দিচ্ছে কেউ কেউ। এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্ট হচ্ছে না। আর নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে বর্ধিত জনসংখ্যার কর্মে সংস্থান করা যাচ্ছে না। বিনিয়োগের এ ধারা অব্যাহত থাকলে কাক্সিক্ষত জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে (জানুয়ারি-জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মার্চ শেষে অর্জিত হয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে গত এপ্রিল ও মে মাসের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল লকডাউন। লকডাউনের সময়সীমা আরো এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে আগামী জুন শেষে বেসরকারি বিনিয়োগ ১০ শতাংশ অতিক্রম করা কষ্টকর হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে, গত প্রায় দুই বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রকৃত অবস্থা ১০ শতাংশের নিচেই অবস্থান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। গত বছরের জুন প্রান্তিকে তা আরো কমে হয় ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সাড়ে ১১ শতাংশ। কিন্তু বিপরীতে লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। আগামী জুন শেষে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এবারো তা ১০ শতাংশের ওপরে যাবে না। আবার যে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে তাও প্রকৃত বিনিয়োগ নয়।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বেসরকারি খাতে ঋণের এ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে মূলত ব্যাংকগুলোর পুরনো ঋণের সাথে নতুন করে মুনাফা বা সুদহার যুক্ত হওয়ার কারণে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে না দিলেও ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দিয়েছে গত বছরের এপ্রিল থেকে। বলা হয়েছে, ক্রেডিট কার্ডের ঋণ ছাড়া আর সব ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ শতাংশ। বিদ্যমান ঋণ ১১ লাখ কোটি টাকা হলে আর এক টাকাও ঋণ বিতরণ না করলেও ৯ শতাংশ সুদহার যুক্ত হওয়ায় বছর শেষে পুঞ্জীভূত ঋণ ১১ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা হবে। এভাবেই বেড়ে যাচ্ছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবাহ।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, তারা প্রকৃতভাবেই টাকার সঙ্কটে ভুগছেন। করোনাভাইরাসের প্রভাবে আয় কমে যাওয়ায় তারা পুঁজির সঙ্কটে পড়েছেন। পুঁজির অভাবে অনেকেই নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে পারছেন না- এমন একজন উদ্যোক্তা জানিযেছেন, তারা টাকার সঙ্কটে ভুগছেন। ব্যাংকগুলো থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না। গত বছর তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের শুধু ঋণের মুনাফাই পরিশোধ করেছেন ২৩ কোটি টাকা। তিনি কখনো খেলাপি ছিলেন না। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে তিনি ব্যাংকের ঋণ এখন ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছেন না। কিন্তু তাদের এই দুর্দিনে ব্যাংক থেকে তেমন কোনো সহযোগিতাও পাচ্ছেন না। উপরন্তু তাদেরকে নানাভাবে নাজেহাল হতে হচ্ছে। এখন ব্যাংকই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে, ওই ব্যবসায়ীর মতো বেশির ভাগ উদ্যোক্তারাই একই সমস্যার কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, ব্যাংক থেকে কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ তারা পাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের এমডি এম কামাল হোসেন জানিয়েছেন, নতুন বিনিয়োগ না দেয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংকগুলোর তহবিলের আন্তঃপ্রবাহ কমে গেছে। কারণ ব্যাংকগুলো এখন ওয়ানসাইডেড হয়ে গেছে। গত এক বছরের ওপরে ব্যাংকগুলো যে ঋণ দিয়েছিল তা আদায় করতে পারছে না। করোনার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে গিয়ে ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা দিয়েছিল। বলা হয়েছিল ঋণ পরিশোধ না করলেও ব্যবসায়ীদের খেলাপি করা যাবে না। এর ফলে ব্যাংকগুলোর গত এক বছর ঋণ আদায় তেমন একটি হয়নি। মেয়াদি বিনিয়োগগুলো থেকে কোনো ঋণ আদায় হয়নি। সাধারণত ঋণ আদায় হলে ওই ঋণ আবার ব্যাংকগুলো নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলো নতুন করে তেমন কোনো বিনিয়োগ করতে পারছে না। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশিত প্রণোদনা প্যাকেজ ও সরকারের ট্রেজারি বিল বন্ডের মধ্যেই অনেকের বিনিয়োগ সীমিত হয়ে পড়েছে। এর বাইরে ব্যাংকগুলোও এখন নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছে। ব্যবসা লোকসানের কারণে মূলধনের দায় যেন পুরোপুরি ব্যাংকের ওপর না পড়ে সেজন্য বিনিয়োগকারীদের অর্ধেক মূলধনের জোগান দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে।
এ দিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মূলত ৯ শতাংশ সুদে ব্যাংকগুলো নতুন বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে না। নির্ধারিত সুদে সরকারের বিল বন্ডেই বিনিয়োগ করছে কেউ কেউ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তার বেশির ভাগই দীর্ঘ মেয়াদের ঋণ। এসব ঋণের সুদহার ৭ থেকে ৯ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। তাদের মতে, নতুন ঋণে ব্যাংকগুলো আগ্রহ বাড়াতে সুদহারের নির্ধারিত সীমা তুলে দিতে হবে। তাহলে ব্যাংকগুলো বেশি মুনাফার আশায় নতুন বিনিয়োগ করতে পারবে।