ঢাকা বুধবার, অক্টোবর ৯, ২০২৪
কভিডকালে দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
  • মো.জিল্লুর রহমান
  • ২০২১-০৪-৩০ ০৯:৫৪:৪০

ইসলাম দুস্থ, নিঃস্ব ও গরিব মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণের ন্যায়সংগত অধিকার বা হকগুলো ফরজ করে দিয়েছে। ইসলামি অর্থনীতিতে সর্বপ্রকার ধন-সম্পদ বণ্টনের মূলনীতির ক্ষেত্রে জাকাতের নির্দেশনা রয়েছে এবং জাকাতের মাধ্যমে মানবসমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা রয়েছে। একশ্রেণির বিত্তবান লোক ধন-সম্পদ ও টাকার পাহাড় গড়বে, আর অপর শ্রেণির গরিব মানুষ চরম ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কশাঘাতে জর্জরিত হবে, এ ধরনের জঘন্য প্রথা ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না। ইসলাম ধনদৌলত, অর্থসম্পদের উদারতা ও ইনসাফের দ্বারা গরিবের ন্যায্য প্রাপ্য, হতদরিদ্রের হক বা অধিকার ব্যাপকভাবে সংরক্ষিত করেছে। ধনীদের অর্থসম্পদের ওপর গরিবের যে হক রয়েছে, পবিত্র কোরআনে তা বারবারই উচ্চারিত হয়েছে।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ধন-সম্পদ যেন শুধু তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।’ (সূরা আল-হাশর, আয়াত-৭) এবং ‘আর তাদের (ধনী লোকদের) সম্পদে অবশ্যই প্রার্থী (দরিদ্র) ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ সুরা আল-জারিআত, আয়াত-১৯)।

‘দানশীলতা’ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই একটি মহৎ গুণ। কোরআন ও হাদিসে দান-সদকার বহু ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘দানশীলতা জান্নাতের একটি বৃক্ষ, যা তাকে জান্নাতে পৌঁছে দেবে।’ (মিশকাত শরীফ)।

জাকাত ইসলামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোকন বা ইবাদত। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হলো সালাত ও জাকাত। কোরআন মজিদে বহু স্থানে সালাত ও জাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ সওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।

জাকাতের আভিধানিক অর্থ পরিশুদ্ধ হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া; জাকাতের পারিভাষায়, কোনো দরিদ্র মুসলমানকে শরিয়ত কর্তৃক মালের নির্ধারিত অংশের মালিক বানিয়ে দেয়া। এ শর্তে যে ওই দরিদ্র মুসলমান রাসুল (সা.)-এর বংশধর বা তাদের আজাদকৃত গোলাম হতে পারবে না এবং ওই মাল থেকে জাকাতদাতার মালিকানা পূর্ণরূপে মুক্ত হতে হবে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করতে হবে।

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, জাকাত দিলে তো সম্পদ কমে। আসলে জাকাত দিলে সম্পদ যেমন পবিত্র হয়, ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহ ওই সম্পদের জিম্মাদার হয়ে যান, ওই সম্পদের কেউ ক্ষতি বা বিনষ্ট করতে পারে না। যদি সঠিক নিয়মে যথাযথভাবে জাকাত প্রদান করা হয়, তবে সে সম্পদ চুরি হয় না, আগুনে পোড়ে না, পচে না, নষ্ট হয় না, কেউ আত্মসাৎ করতে পারে না। যেমন দুই ভাই একই ব্যবসা বা চাকরি করে সমান আয় করে।

দৈহিক ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নামাজ, ঠিক তেমনিভাবে আর্থিক ইবাদতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জাকাত। সীমাহীন গুরুত্বের কারণে এই দুটি ইবাদতের কথা আল্লাহ পবিত্র কোরআনে পাশাপাশি বর্ণনা করেছেন। ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। অনেকে হিসাবনিকাশ না করে কিছু অংশ জাকাত মনে করে দান করি। আসলে এ ধরনের দান জাকাত হিসাবে পরিগণিত হয় না, সাধারণ দান হতে পারে। জাকাত প্রদানের সময় যথাযথভাবে নিসাব পরিমাণ হিসাব করে দান করতে হয় এবং তখনই জাকাতের হক আদায় হয়।

জাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত: নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ, বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা, কিংবা সমপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার মালের মালিক হওয়া; ২. মুসলমান হওয়া। কাফেরের ওপর জাকাত ফরজ নয়; ৩. বালেগ হওয়া। নাবালেগের ওপর জাকাত ফরজ নয়; ৪. জ্ঞানী ও বিবেকসম্পন্ন হওয়া। সর্বদা যে পাগল থাকে তার নিসাব পরিমাণ মাল থাকলেও তার ওপর জাকাত ফরজ নয়; ৫. স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া। দাস-দাসীর ওপর জাকাত ফরজ নয়; ৬. মালের ওপর পূর্ণ মালিকানা থাকা। অসম্পূর্ণ মালিকানার ওপর জাকাত ফরজ হয় না; ৭. নিসাব পরিমাণ মাল নিত্যপ্রয়োজনীয় সম্পদের অতিরিক্ত হওয়া; ৮. নিসাব পরিমাণ মালের ওপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া; ৯. মাল বর্ধনশীল হওয়া। জাকাতের ফজিলত, আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যা কিছু (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় কর, তিনি তার বিনিময় দান করবেন। আর তিনিই উত্তম রিজিকদাতা। (সুরা সাবা, আয়াত:৩৯)

সুরা তওবার ৬০নং আয়াতে জাকাতের আটটি খাত উল্লেখ করা হয়েছে। যথাÑ১. ফকির। ওই গরিব ব্যক্তি যার নিকট এক বেলা বা দুই বেলার বেশি খাবারের ব্যবস্থা নেই; ২. মিসকিন। যার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। যেমন কোনো ব্যক্তির আয় আছে ‘২০ হাজার’ টাকা, কিন্তু তার নিজের বা পরিবারের কারও অসুস্থতার পেছনে ব্যয় আছে ‘৪০ হাজার’ টাকা। তাকে দেয়া; ৩. জাকাত আদায় ও বিতরণের কর্মচারীদের; ৪. নওমুসলিম অর্থাৎ যারা অন্য ধর্ম ছাড়ার কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের দেয়া; ৫. দাসমুক্তির জন্য। (বর্তমানে যদি কোনো লোক এমন পাওয়া যায় যে, যে নির্দোষভাবে জেলে আছে তাকে); ৬. ঋণমুক্তির জন্য। জীবনের মৌলিক বা প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য সংগত কারণে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের ঋণমুক্তির জন্য জাকাত প্রদান করা যাবে; ৭. ফি সাবিলিল্লাহ বা জিহাদ। অর্থাৎ ইসলামকে বোল-বালা বা বিজয়ী করার লক্ষ্যে যারা কাফির বা বিধর্মীদের সঙ্গে জিহাদে রত সেসব মুজাহিদের প্রয়োজনে জাকাত দেয়া যাবে; ৮. মুসাফির। মুসাফির অবস্থায় কোনো ব্যক্তি বিশেষ কারণে অভাবগ্রস্ত হলে ওই ব্যক্তির বাড়িতে যতই ধন-সম্পদ থাকুক না কেন তাকে জাকাত প্রদান করা যাবে।

এ কারণেই অসহায় দরিদ্রের স্বাভাবিকভাবে জীবনধারণের জন্য ধনীদের প্রতি তাদের অধিকারকে নির্দিষ্ট করেছে। ইসলামি অর্থনীতিতে জাকাত, ফেতরা, সদকা ও দান-খয়রাত কেবল গরিবদের বেলায় প্রাপ্য। আসলে এগুলো হলো দরিদ্রদের মৌলিক অধিকার। জাকাতের মাধ্যমে অভাবী, দুর্দশাগ্রস্ত, অসহায়, ক্ষুধার্ত, নিঃস্ব ও দরিদ্র লোকজনের অভাব-অনটন দূর করা এবং অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করা সম্ভব। ইসলামে জাকাত ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যই হলো মানবসেবা তথা হতদরিদ্র মুসলমানদের আর্থসামাজিক জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক হকদারকে তার ন্যায্য অধিকার দিয়ে দাও।’ (বুখারি)। সমাজে দরিদ্রদের মৌলিক অধিকার যেমন ইসলাম স্বীকার করেছে, পাশাপাশি অত্যন্ত গুরুত্বসহ তাদের সম্মানজনক মর্যাদাও দিয়েছে। নবী করিম (সা.)-এর ফরমানÑ‘আমির ও ধনী লোকের ৪০ বছর আগে দরিদ্র বা গরিব লোকেরা জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা করবেন, ‘তোমরা দেখো তো, আমার প্রিয় বান্দাকুল কোথায়?’ ফেরেশতারা নিবেদন করবেন, ‘হে রাব্বুল আলামিন! কারা আপনার প্রিয় বান্দা?’ আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তর আসবে, ‘তারা হবে মুসলমান গরিব-দরিদ্র লোক, আমার দানে ও নেয়ামতে তারা পরিতৃপ্ত এবং সন্তুষ্ট ছিল তাদের জান্নাতে নিয়ে যাও।’

হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত এবং ব্যবসায়ের পথ ধরে উপার্জিত বিপুল সম্পদ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কল্যাণে, ইসলামের প্রয়োজনে উজাড় করে দিয়েছিলেন। নিজের আগামী দিনের প্রয়োজন আর পরিবার ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা কখনও তাঁর দানের হাতকে সংকুচিত করতে পারেনি। তাবুক অভিযানের সময় আল্লাহর রাসুলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে প্রতিযোগিতামূলক দান করতে লাগলেন। সবার আগে তিনি তাঁর সমুদয় সম্পদ আল্লাহর রাসুলের সামনে পেশ করলেন। হজরত উসমান (রা.) দিলেন ৯০০ উট, ১০০ ঘোড়া এবং বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও সোনা। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) দিলেন সাড়ে ২৯ কিলো রৌপ্য মুদ্রা। হজরত আস ইবনে আদি (রা.) দিলেন সোয়া ১৩ টন খেজুর। হজরত ওমর, তালহা, সাদ ইবনে উবাদা এবং মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রা.) গোটা সম্পদের অর্ধেক দান করলেন। সবশেষে রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু বকর! ঘরে কী রেখে এসেছেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলকে রেখে এসেছি।’ তাঁদের প্রত্যেকের দান ইসলামের ইতিহাসে সমুজ্জ্বল এবং একেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এ বছর কভিড মহামারির কারণে বহু অসহায় মানুষ বিশেষ করে গরিব ও দুস্থ লোকজন খাদ্যের অভাবে না খেয়ে আছে। বহু কষ্টে দিনাতিপাত করছে। অনেকে সচ্ছল কিন্তু কভিডের কারণে আয়-রোজগার বন্ধ এবং এ কারণে লোকলজ্জার ভয়ে কারও কাছে সাহায্য চাইতে পারছে না। বাসাভাড়া পরিশোধ করতে পারছে না। খাবারের অভাবে রোজা পালন করতে পারছে না। বছরের যে কোনো সময় জাকাত দেয়া যায়, কিন্তু বেশি সওয়াব ও ফজিলাতের আশায় আমরা রমজান মাসকেই উত্তম সময় হিসেবে বেছে নিই। যারা জাকাত দেয়, তারা অবশ্যই সচ্ছল। তারা ইচ্ছা করলে জাকাতের অতিরিক্তও দান করতে পারেন। এ বছর জাকাত প্রদানের পর একটু বেশি দান করে গরিব ও দুস্থদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে গরিবরা যেভাবে উপকৃত হবে, ঠিক তেমনিভাবে দানকারীও রমজান মাস উপলক্ষে অনেক সাওয়াবের মালিক হবে। তাই আসুন! আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-কে খুশি করি। আমরা অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াই, আমাদেরর জাকাত-ফিতরার পয়সায় যেন হাসি ফোটে ভাগ্যহত মানুষের মুখে। আমিন।

ব্যাংকার ও মুক্ত লেখক

zrbbbp@gmail.com

ইসলামের দৃষ্টিতে ভূমিকম্প হওয়ার কারণ কী?
যেমন ছিল অমুসলিমদের সঙ্গে নবীজির আচরণ
ফিলিস্তিন নিয়ে কোরআন-হাদিসে কী বলা হয়েছে