২০১১ সালে দেশের ব্যাংক খাতে অবলোপনকৃত (রাইট অফ) ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের জুন শেষে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকায়। এভাবে ১০ বছরে ব্যাংক খাতে আদায় অযোগ্য ঋণ রাইট অফ করা হয়েছে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১০ বছরে রাইট অফকৃত ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দুই দশমিক ১৪ গুণ বৃদ্ধি পেলেও বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর বৃদ্ধি পেয়েছে তিনগুণের বেশি। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় খেলাপির পরিমাণ বৃদ্ধির হার তুলনামূলক কম ছিল, যা আন্তর্জাতিক মানের নিচেই ছিল। কিন্তু গত এক দশকে তা উচ্চহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জানা গেছে, রাইট অফ করা এসব ঋণের বিপরীতে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন কেটে রাখতে হয়েছে ব্যাংকের মুনাফা থেকে। এসব ঋণ আদায় হওয়াসাপেক্ষে প্রভিশনে রাখা সমপরিমাণ অর্থ কেটে নিয়ে যোগ হবে মুনাফায়। ফলে রাইট অফ করা ঋণের সঙ্গে আরও ২৪ হাজার কোটি টাকার মুনাফা আটকে আছে দেশের ব্যাংক খাতে। এতে ব্যাংকগুলোর বিশাল অঙ্কের অর্থ আটকে গেছে অনুৎপাদনশীল খাতে, যা ব্যাংকগুলোর তারল্য প্রবাহকে সংকুচিত করে ফেলেছে। পাশাপাশি ন্যায্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীরা।
ঋণ বিতরণের পর তা আদায় না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী শ্রেণীকরণ করা হয়। খেলাপি হওয়া ঋণগুলো মান অনুযায়ী নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড, সন্দেহজনক ও মন্দ বা আদায় অযোগ্য এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করতে হয় ব্যাংকগুলোকে।
আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতি মানতে প্রভিশনের আকার সময়ে সময়ে নির্ধারণ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত মান অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে নিয়মিত বা অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং কু বা আদায় অযোগ্য ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
আদায় অযোগ্য হওয়া খেলাপি ঋণগুলোকে মূল আর্থিক বিবরণী থেকে বাদ দেয়াকে ব্যাংকিং ভাষায় রাইট অফ বা অবলোপন বলা হয়। পৃথক একটি খাতায় তা সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে রাইট অফ প্রচলন শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০০৩ সাল থেকে। এর পূর্ব পর্যন্ত সব খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেখাতে হতো ব্যাংকগুলোকে। রাইট অফ করার আগে সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের।
এভাবে বছর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাংকের কিছুটা কমে আসে। গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বেশি প্রভিশন রাখতে হয়েছে। উচ্চহারের খেলাপির কারণে কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে রাইট অফ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা, ২০১২ সালের একই সময়ে তা দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে জুন শেষে তা এক লাফে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৫ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। এক বছরে বৃদ্ধি পায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
এরপরের বছর থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে রাইট অফের পরিমাণ। ২০১৪ সালের জুন শেষে তা দাঁড়ায় ৩২ হাজার ১১০ কোটি টাকা, ২০১৫তে ৩৭ হাজার ৬৫০ কোটি, ২০১৬তে ৪২ হাজার ২২৬ কোটি, ২০১৭তে ৪৫ হাজার ৫৩০ কোটি, ২০১৮তে ৪৮ হাজার ৯০০ কোটি, ২০১৯-এ ৫৪ হাজার ৪৬০ কোটি ও সর্বশেষ ২০২০ সালের জুন শেষে তা দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। এভাবে গত ১০ বছরে ব্যাংকগুলো ২৩ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার ঋণ নতুন করে রাইট অফ করেছে।
জানা গেছে, রাইট অফকৃত ঋণের মধ্যে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো করেছে ১৭ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংক তিন হাজার ৩৮০ কোটি, বেসরকারি ব্যাংক ২৩ হাজার ৯৪০ কোটি ও বিদেশি শাখার ব্যাংকগুলোর স্থিতি হচ্ছে এক হাজার ১০ কোটি টাকা মাত্র।
২০১১ সালের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে তা উন্নীত হয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকায়।